কাফির কারা, সে ব্যাপারে মোল্লাতান্ত্রিক বয়ান বেশ অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর। যারা অমুসলিম তারাই কাফির, এমন একটি গতানুগতিক ধারণা চলে আসছে। নাস্তিকদেরকে কাফির সম্বোধন করা হয় কাফিরের প্রকৃত অর্থ না বুঝে। কিন্তু কুর’আনে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে, কাফির তারাই যারা সত্যকে জেনেবুঝে প্রত্যাখ্যান করে এবং সত্যের বিরুদ্ধাচারণ করে। একজন নাস্তিক যতোক্ষণ সততার সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করছে কিন্তু সত্যকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়ে ঈশ্বরে বিশ্বাস আনতে পারেনি, সে কাফির নয়। একইভাবে কোনো সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে কিতাবের জ্ঞান না থাকলে, বা তাদের কাছে কোনো রাসুল কিতাব নিয়ে না এলে তাদেরকে কাফির বলে দোষারোপ করা যায় না।

..‘আর সে (ফিরাউন) বললো, আমরা কি তোমাকে আমাদের মাঝে সযত্নে লালনপালন করিনি? তুমি কি তোমার জীবনের এক দীর্ঘ সময় আমাদের সাথে কাটাওনি? অথচ তুমি যা করলে! তুমিতো কাফির (আল-কাফিরি)।’ (কুর’আন,২৬/১৮).

২৬/১৮ আয়াতে ফিরাউন তার পরিবারে পালিত মুসানবীকে কাফির সম্বোধন করে তিরষ্কার করেছিলো। এটি পরিষ্কার যে এখানে কাফির বলতে ’অকৃতজ্ঞ’ বোঝানো হয়েছে। মুসানবী ফিরাউনের পরিবারে শৈশব অবস্থায় আশ্রিত হয়ে বড় হয়েছিলেন, তবু তিনি ফিরাউনের ভ্রান্তবিশ্বাস, অহংকার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধাচারণ করেন। তাই তিনি ফিরাউনের চোখে একজন কাফির।

.২৬/১৮ আয়াত থেকে আরও বোঝা যায় কাফির কথাটি কুর’আনের নাযিলের অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিলো, আর কুর’আনে প্রচলিত অর্থটিকে গ্রহণ করেই আয়াতগুলিতে প্রযুক্ত হয়েছে।

..আরও কিছু আয়াত পাঠ করা যেতে পারে।–‘তারচেয়ে বড় অন্যায়কারী কে হতে পারে যে আললাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলে ও সত্য আসার পরও তা প্রত্যাখ্যান করে? কাফিরদের জন্য জাহান্নামই কি আশ্রয়স্থল নয়?’ (কুর’আন,৩৯/৩২)

‘আর যার কাছে সত্য এসেছে ও তাতে বিশ্বাস করেছে, এমনই ব্যক্তিরাই আললাহ-সচেতন (আল-মুতাকুনা)।‘(কুর’আন,৩৯/৩৩)

.৩৯/৩২,৩৩ আয়াত দু’টি থেকে সুস্পষ্ট হয়, কাফির তারাই যাদের কাছে সত্য পৌঁছুনোর পরও প্রত্যাখ্যান করেছে, এবং সত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে, কাফিরদের বিপরীতে অবস্থানে আছে মুহসিনিনাদের যারা আললাহ-সচেতন (আল-মুতাকুনা), যারা সত্যপ্রাপ্ত হয়ে তাতে বিশ্বাস এনেছে।.

‘যখন তাদের কাছে আললাহ’র পক্ষ হতে একটি কিতাব এসে পৌঁছুলো, যা সে বিষয়ের সত্যায়ন করে, যা তাদের কাছে রয়েছে এবং তারা যা পূর্ব হতেই পাঠ করতো ও কাফিরদের উপর বিজয় কামনা করতো। অবশেষে যখন তাদের কাছে তা পৌঁছলো, যা তারা বুঝতে পেরেছিলো, অথচ তখন তারা তা প্রত্যাখ্যান করলো (কাফারু)। অতএব, কাফিরদের (সত্যঅস্বীকারকারীদের) প্রতি আললাহ দোষারোপ (ফালা’নাতু) করেন।‘ (কুর’আন,২/৮৯).

‘যার বিনিময়ে তারা নিজেদের বিক্রি করেছে, তা কতো না মন্দ। যেহেতু তারা আললাহ যা নাযিল করেছেন তা প্রত্যাখ্যান করছে (ইয়াকফুরু), এই ঈর্ষার কারণে যে আললাহ তার বান্দাদের মধ্য হতে তাঁর ইচ্ছাঅনুসারে কাউকে অনুগ্রহ করলেন। অতএব, তারা ক্রমে প্রবেশ করেছে ঈর্ষার গভীরে আরও ঈর্ষায়। কাফিরদের (সত্যস্বীকারকারী অকৃতজ্ঞদের) জন্য আছে বমাননাকর দুর্ভোগ।’ (কুর’আন,২/৯০).

‘আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আললাহ যা নাযিল করেছেন তাতে বিশ্বাস আনো,’ তারা বলে, ‘আমাদের কাছে যা অবতীর্ণ হয়েছে আমরা (শুধু) তাই বিশ্বাস করি। আর সেটি ছাড়া তারা অন্যকিছু প্রত্যাখ্যান করে, অথচ এটি সত্য (আল হক), যা তাদের সাথে যা রয়েছে তার সত্যায়ন করে। বলো, ‘তবে কেনো তোমরা পূর্বের নবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে? যদি বিশ্বাসীই ছিলে?’ (কুর’আন,২/৯১).

২/৮৯-৯১ আয়াতগুলি থেকে প্রতীয়মান হয় কাফির তারাই যারা সত্যকে জেনে বুঝে প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের ঈর্ষা ও জিদের কারণে। শুধু প্রত্যাখ্যান নয় তারা বিদ্রোহীও বটে।.

‘আর যখন মালাইকাতদের প্রতি নির্দেশ করলাম,আদমকে মান্য করো (উসজুদু),তখন তারা মান্য করলো, ইবলিস ব্যতীত। সে অহংকারবশত অস্বীকার করলো। আর সত্যস্বীকারকারী অকৃতজ্ঞদের (কাফিরিনা) অন্তর্ভূক্ত হলো।’(কুর’আন,২/৩৪).

.ইবলিস আললাহ’র প্রতি বিশ্বাস এনেছিলো, অর্থাৎ সে নাস্তিক ছিলো না, সে সত্যকে জানতো, অথচ অহংকারের কারণে বিদ্রোহী হলো ও অকৃতজ্ঞ হলো, অর্থাৎ কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হলো।.

‘দুই দলের পরষ্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবশ্যই তোমাদের জন্য নিদর্শন আছে। একদল আললাহ’র পথে যুদ্ধ করেছিলো, অন্য দলটি ছিলো কাফিরদের, যারা তাদের চোখের নজরে নিজেদের দ্বিগুণ দেখেছিলো। আললাহ যাকে চান সাহায্য করেন। এতে অন্তর্দৃষ্টসম্পন্নদের জন্য আছে এক শিক্ষা।‘ (কুর’আন,৩/১৩).

৩/১৩ আয়াতে আমরা দেখতে পাচ্ছি সত্যপ্রত্যাখ্যানকারী কাফিররা সত্যগ্রহণকারী বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে লড়াইরত।.

‘আহলে-কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কাফের তারা ততোক্ষণ পর্যন্ত পরিত্যাক্ত হয়নি (সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়নি) যতোক্ষণ পর্যন্ত না তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ এসেছে।'(কুর’আন,৯৮/১)

.

৯৮/১ আয়াতে বলা হয়েছে সত্যের সুস্পষ্ট প্রমাণ না আসা পর্যন্ত অবিশ্বাসীরা পরিত্যাক্ত হয়নি। বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ।

..

উপসংহারঃ

কাফির সংক্রান্ত কুর’আনের আয়াতগুলি পর্যালোচনা করে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে কাফির অর্থ এমন সত্যপ্রত্যাখ্যানকারী ব্যক্তি যে সত্যেকে জেনেবুঝে অস্বীকার করে ও তার বিরুদ্ধাচারণ করে। কাফিররা শুধু অকৃতজ্ঞ নয়, তারা কৃতঘ্নও বটে। অকৃতজ্ঞতা হচ্ছে কারো উপকার স্বীকার না করা,কিন্তু কৃতঘ্ন ব্যক্তি যে তার উপকার করেছে তার অপকার করে।

Source:https://www.facebook.com/groups/379960723877525/permalink/459920569214873/

221 ShareLikeCommentShare

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *