কুরআনে বর্ণীত দুটি শব্দ “রাসূল” এবং “নবী” এর মধ্যে পার্থক্যের সংক্ষিপ্তসার:

লোকেরা প্রায়শই রাসূলকে মানা ও অনুসরণ করার জন্য কুরআনের নির্দেশকে ভুল বুঝে থাকে, কারণ তারা কুরআনে বর্ণীত “নবী” এবং “রাসূল” শব্দ দুটির অর্থের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে না। নবী মুহাম্মদ হলেন সেই নশ্বর মানুষটি, যার ছিল সাধারন মানবিক গুন, তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়গুলি ও তাঁর চারপাশের লোকদের সাথে তাঁর সামাজিক সম্পর্ক। তিনি একাধারে ছিলেন কারো স্বামী, কারো পিতা, কারো ভাই, কারো ভাইপো, রাষ্ট্র প্রধান, সেনাপতি ইত্যাদি এবং এই সকল দায়িত্ব তিনি মানবিক আচরনের মাধ্যমেই সম্পন্ন করেছিলেন। অন্যান্য মানুষের মতোই মানবিক আচরণের কারণে তিনি ভুল করেছেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর ভুলের জন্য কুরআনে একাধিকবার তিরস্কার ও সাবধান করেছেন: “হে নবী! আল্লাহ আপনার জন্য যা অনুমতি দিয়েছেন, আপনার স্ত্রীকে খুশি করার জন্য আপনি কেন নিষিদ্ধ করেছেন? …” (৬৬:১)। আত্মরক্ষার লড়াইয়ের পরে মুহাম্মদকে বন্দীদের সম্পর্কে তিরস্কার করা হয়েছে: “নবীর পক্ষে উচিত নয় বন্দীদিগকে নিজের কাছে রাখা, যতক্ষণ না দেশ পদানত হয়। তোমরা পার্থিব সম্পদ কামনা কর, অথচ আল্লাহ চান আখেরাত। …” (৮:৬৭)। এই আয়াতটি সমস্ত ভাববাদীদের সম্পর্কে: “আর কোন বিষয় প্রতারনা করা নবীর কাজ নয়। আর যে লোক প্রতারনা করবে সে কিয়ামতের দিন সেই প্রতারিত সামগ্রি নিয়ে আসবে। …” (৩:১৬১)। মুহাম্মদকে তাঁর বহুশাস্ত্রবাদী আত্মীয়দের ক্ষমা করার জন্য আল্লাহকে অনুরোধ করার কারনে তিরস্কার করা হয়েছে: “নবী ও মুমিনের উচিত নয় মুশরেকদের মাগফেরাত কামনা করে, যদিও তারা আত্নীয় হোক একথা সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে তারা দোযখী।” (৯:১১৩)। আল্লাহ অবিশ্বাসী ও মুনাফিকদের আনুগত্যের জন্য মুহাম্মদকে তিরস্কার করেছেন: “হে নবী! আল্লাহকে ভয় করুন এবং কাফের ও কপট বিশ্বাসীদের কথা মানবেন না। …” (৩৩: ১)।

লক্ষ্য করুন যে এই সমস্ত আয়াতগুলিতে “নবী” শব্দটি ব্যবহার হয়েছে, “রাসূল” শব্দটি নয়। এটি তাঁর স্ত্রীদের সাথে মুহাম্মদ সম্পর্কে আয়াতগুলিতে প্রযোজ্য: “হে নবী! আপনার স্ত্রীগণকে বলুন, তোমরা যদি পার্থিব জীবন ও তার বিলাসিতা কামনা কর…” (৩৩:২৮); “হে নবী পত্নীগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকাশ্য অশ্লীল কাজ করলে তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হবে।.. “(৩৩:৩০); ” হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; … “(৩৩:৩২)। একিভাবে নবী শব্দটি প্রযোজ্য, মুহাম্মদ যখন শিক্ষক, একজন পিতা, স্বামী, প্রতিবেশী, সহচর, একজন বণিক, একজন নেতা এবং স্টেটের প্রধান: “হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। … “(৩৩:৫৯);” নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ … “(৩৩: ৬);” ওহে আপনারা যারা বিশ্বাস করেন! নবীর বাড়িতে প্রবেশ করবেন না, যদি না অনুমতি দেওয়া হয় … “(৩৩:৫৩);” … এবং তাদের একটি দল নবীকে তাদের ক্ষমা করতে বলেছিল … “(৩৩:১৩)।

বিপরীতে, মুহাম্মদকে কেবল কুরআন পাঠ/পৌঁছে দেওয়ার সময় রাসূল হিসাবে গণ্য করা হয় এবং কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে এই রাসূলকেই মান্য করতে আল্লাহর আনুগত্য করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের বলা হয়েছে। মুহাম্মদ তখনই রাসূল যখন তিনি কুরআনের বাণী পাঠ করেন এবং মানুষের কাছে পৌছিয়ে দেন। বাকি সময়ে তিনি নবী। রাসূলকে মানার অর্থই হল আল্লাহকে মানা, কারন আল্লাহ রাসূলের কাছে পাঠানো বাণীর মাধ্যমেই মানুষকে আদেশ, নিষেধ ও উপদেশ দিয়ে থাকেন : “যে লোক রসূলের হুকুম মান্য করবে সে আল্লাহরই হুকুম মান্য করল। …” (৪:৮০)।

কুরআন এমনকি একক উদাহরণ বা ঘটনার মধ্যেও কখনও উল্লেখ করেনি যে লোকেদের ”নবী”কে মান্য করা উচিত। এর কারণ হ’ল, নবীর আনুগত্য করা মানে একজন নশ্বর মানুষের আনুগত্য করা, যিনি মানবিক কারনে ভুল ঠিক উভয়ই ছিলেন। যে কারণে কুরআনে ভুলের কারনে নবী মুহাম্মদকে তিরস্কার করা হয়েছে, কিন্তু কোথাও রাসূলকে নয়। কুরআনের “রাসূল” শব্দ বেশ কয়েকটি অর্থ বোঝায়: মুহাম্মদ নিজেই (দেখুন ৩৩:৪০), রাসূল (জিব্রাইল) (দেখুন ৮১:১৯), এমন রাসূল (ফেরেশতা) যারা মানুষের কাজ রেকর্ড করছেন (দেখুন ৪৩:৮০), মৃত্যুর রাসূল (ফেরেশতা) ( দেখুন ৭:৩৭), এবং সাধারণভাবে নশ্বরদের মধ্যে প্রেরিত নশ্বর মানুষ রাসূল (দূত) (১২:৫০ দেখুন)। অন্যান্য কুরআনিক প্রসঙ্গে, “রাসূল” এর অর্থ কুরআন নিজেই বা বার্তা। মুহাম্মদ মারা গেছেন। কিয়ামত অবধি রাসূল হ’ল কুরআন নিজেই। আমাদের রাসূল অর্থাৎ কুরআন মেনে চলতে হবে একমাত্র সরল পথ হিসাবে: “আর তোমরা কেমন করে কাফের হতে পার, অথচ তোমাদের সামনে পাঠ করা হয় আল্লাহর আয়াত সমূহ এবং তোমাদের মধ্যে রয়েছেন তাঁর রসূল। আর যারা আল্লাহর কথা দৃঢ়ভাবে ধরবে, তারা হেদায়েত প্রাপ্ত হবে সরল পথের। ” (৩:১০১); আমাদের জন্য এখানে “তাঁর রাসূল” শব্দটির অর্থ কুরআন নিজেই, মুহাম্মদ নয়। “রাসূল” শব্দটি মুহাম্মদকে কেবল তখনই বোঝায় যখন তিনি কুরআনকে পাঠ করেছিলেন/ প্রচার করেছিলেন: “হে রসূল, পৌছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌছালেন না। …” (৫:৬৭)। ” রাসূলের একমাত্র কর্তব্য হ’ল পৌছিয়ে দেওয়া… ” (৫:৯৯)।

কুরআনে পড়লে বোঝা যায়, কোনটি নবী মুহাম্মদের বাণী, আর কোনটি রাসূল মুহাম্মদের বাণী।

কুরআনে আল্লাহ মুহাম্মদকে নবী হিসাবে তার উচ্চারিত কিছু বাণীর জন্য প্রশংসা করেছেন এবং নিন্দা করেছেন এবং মুহাম্মদের কিছু বাণী কোন একটি পরিস্থিতির অংশ হিসাবে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, তিরস্কার বা প্রশংসা ছাড়াই। নীচে তিনটি উদাহরণ দেওয়া হল।

(ক) আল্লাহ মুহাম্মদের প্রশংসা করেছেন যখন তিনি যুদ্ধের কিছু আগে তার অনিচ্ছুক এবং ভীত সঙ্গীদের উৎসাহিত করেছিলেন: “যেমন করে তোমাকে তোমার প্রভু ঘর থেকে বের করেছেন ন্যায় ও সৎকাজের জন্য, অথচ ঈমানদারদের একটি দল (তাতে) সম্মত ছিল না।। এর পরে স্পষ্ট করার পরেও সত্য সম্পর্কে আপনার সাথে তর্ক করছিল, যেন তারা দেখতে দেখতে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে।” (৮:৫-৬); “আপনি যখন বলতে লাগলেন মুমিনগণকে-তোমাদের জন্য কি যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের সাহায্যার্থে তোমাদের পালনকর্তা আসমান থেকে অবতীর্ণ তিন হাজার ফেরেশতা পাঠাবেন?” (৩:১২৪)। মুহাম্মদ, যিনি তাঁর সঙ্গীদের উৎসাহিত করার জন্য আল্লাহ কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছিলেন, সেই পুরো প্রেক্ষাপটটি জানতে হলে আপনাকে পড়তে হবে সূরা আল ইমরানের (৩) ১২১ থেকে ১২৯ আয়াত।

(খ) যখন মুহাম্মদ এই বাক্যাংশটি বলেছিলেন “.. আমার কাছে এমন কিছুই নেই যে, তার উপর তোমাদের সওয়ার করাব ..” (৯:৯২) সেইসব ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে যাদের উট বা ঘোড়া ছিল না এবং যারা আত্মরক্ষায় অংশগ্রহণ করতে চায় সামরিক জিহাদের প্রচেষ্টায়। এটি একটি পরিস্থিতি/গল্পের প্রেক্ষাপটে প্রশংসা বা নিন্দা ছাড়াই উল্লেখ করা হয়েছে; ৯:৯০-৯৫ দেখুন।

(গ) আল্লাহ মুহাম্মাদকে তার দত্তক পুত্রের বিবাহ বিচ্ছেদকারী স্ত্রীকে বিবাহ করার আদেশ পালনে অনিচ্ছুক হওয়ার জন্য এবং এই দত্তক পুত্র, যায়েদকে তার স্ত্রীর সাথে পুনর্মিলন করতে বলার জন্য তিরস্কার করেছেন: “আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন; আপনিও যাকে অনুগ্রহ করেছেন; তাকে যখন আপনি বলেছিলেন, তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছেই থাকতে দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর। আপনি অন্তরে এমন বিষয় গোপন করছিলেন, যা আল্লাহ পাক প্রকাশ করে দেবেন আপনি লোকনিন্দার ভয় করেছিলেন অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত। অতঃপর যায়েদ যখন যয়নবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ কার্যে পরিণত হয়েই থাকে।” (৩৩:৩৭)।

নবী মুহাম্মদের বাণীর সাথে ঘটনা, পরিস্থিতি এবং স্থানিক প্রসঙ্গ জড়িত রয়েছে। এই পরিস্থিতির সাথে জড়িত লোকেরা মারা গিয়েছে, কিন্তু নৈতিক শিক্ষা এখনও রয়েছে: (১) মুহাম্মদ এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি ঠিক ভুল উভয়ই করেছিলেন এবং কুরআনে তাকে ভাল কাজের প্রশংশা এবং ভুলের জন্য তিরস্কার করা হয়েছে (২) তাঁর করা কোন বাণী বা কাজকে কখনই ইসলামের অংশ করা হয় নি এবং (৩) তথাকথিত হাদিস, বর্ণনা এবং মুহাম্মদের জীবনী যা আব্বাসীয় যুগের পরবর্তী প্রজন্মের দ্বারা রচিত, নিছক বানোয়াট। মুহাম্মদের একমাত্র বাণী যা ইসলামের অংশ (বলুন/কুল”…”) এবং (তারা আপনাকে জিজ্ঞাসা করে/ইয়াসআলুনাকা … বলো/কুল,”…”) অভিব্যক্তি সম্বলিত আয়াতে পাওয়া যায়। মুহাম্মাদ ছিলেন একজন মহান নবী, যিনি আল্লাহর বাণী তথা অকাট্য কুরআনকে মান্য করেছিলেন এবং এর সম্পূর্ণ পাঠ্য বিতরণ করেছিলেন।

কোরানের এই আয়াত থেকে জানা যায় যে, মুহাম্মদের জীবদ্দশায় মুশরিক আরবরা কুরআনের প্রতি তাদের ঘৃণা প্রকাশ করেছিল। তারা মুহাম্মদকে বোঝানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল কুরআনের বাণীগুলির পরিবর্তন করার জন্য: “এবং যখন তাদের কাছে আমাদের সুস্পষ্ট আয়াত পাঠ করা হয়, তখন যারা আমাদের সাথে সাক্ষাতের আশা করে না তারা বলে, “এটি ব্যতীত অন্য একটি কুরআন আনুন বা এটি পরিবর্তন করুন। বলুন, একে নিজের ইচ্ছায় পরিবর্তন করা আমার কাজ নয়। আমি সে নির্দেশেরই আনুগত্য করি, যা আমার কাছে আসে। আমি যদি স্বীয় রবের নাফরমানী করি, তবে কঠিন দিবসের আযাবের ভয় করি। বলুন, আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমি তা তোমাদের কাছে পাঠ করতাম না এবং তিনি তোমাদেরকে তা জানাতেন না। এর আগে আমি সারাজীবন তোমাদের মাঝে বেঁচে আছি। তোমরা কি বুঝ না?”” (১০:১৫-১৬)। সুতরাং, কুরআন বিদ্বেষীরা মুহাম্মদকে কুরআনের বাইরে আল্লাহর ধর্ম সম্পর্কে কথা বলাতে চেয়েছিল এবং তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

এরপরেও কুরআনের বিদ্বেষীরা মুহম্মদকে একদিন না একদিন আপস করানোর আশা ছেড়ে দেয়নি। আল্লাহ তাকে সতর্ক করেছেন: “সুতরাং মিথ্যারোপকারীদের আনুগত্য করবেন না। তারা চায় আপনি আপস করলে, তারা ও আপস করবে।” (৬৮:৮-৯)।

সেই মুশরিকরা তাদের মন্দ পরিকল্পনার দ্বারা মুহাম্মদকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেই ফেলত, যদি আল্লাহ মুহাম্মদকে সুরক্ষা এবং কুরআন সংরক্ষণ না করতেন। পাঠকদের এই তিনটি আয়াত গভীরভাবে চিন্তা করার জন্য উপদেশ দিচ্ছি: “তারা তোমাকে প্রায় প্রলোভিত করেছিল যা আমরা তোমার কাছে ওহী করেছি, পরিবর্তে তুমি আমাদের নামে অন্য কিছু উদ্ভাবন করতে পার। সেক্ষেত্রে, তারা তোমাকে একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করবে। আমি তোমাকে দৃঢ়পদ না রাখলে তুমি তাদের প্রতি কিছুটা ঝুঁকেই পড়তে। তখন আমি অবশ্যই তোমাকে ইহজীবনে ও পরজীবনে দ্বিগুণ শাস্তির আস্বাদন করাতাম। এ সময় তুমি আমার মোকাবিলায় কোন সাহায্যকারী পেতে না।” (১৭:৭৩-৭৫)।

আল্লাহ কুরআনে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে মুহাম্মদ কুরআনের বাইরে আল্লাহর ধর্ম সম্পর্কে কখনও কথা বলেননি এবং কুরআন ছাড়া আর কিছুই প্রচার করেননি: “এটা বিশ্বপালনকর্তার কাছ থেকে অবতীর্ণ। সে যদি আমার নামে কোন কথা রচনা করত, তবে আমি তার দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেলতাম, অতঃপর কেটে দিতাম তার গ্রীবা। তোমাদের কেউ তাকে রক্ষা করতে পারতে না। এটা খোদাভীরুদের জন্যে অবশ্যই একটি উপদেশ।” (৬৯:৪৩-৪৮)। এইভাবে, প্রকৃত বিশ্বাসীদের এই ঐশী ওহীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়; অর্থাৎ, কুরআন এবং তারা তাদের কামনা-বাসনাকে অনুসরণ করবে না।

আল্লাহ মুহাম্মদকে রক্ষা করেছিলেন বলেই, মুশরিকরা শত চেষ্টা করেও মুহাম্মদের জীবদ্দশায় মুহাম্মদকে দিয়ে কুরআনের বাইরে তাদের ইচ্ছা আকাঙ্খা অনুযায়ী কোন নির্দেশ, বিধান বলাতে বা চালু করতে পারেনি। নুতন নুতন বিধান ও রিচুয়াল চালু করার তাদের সেই ইচ্ছা পুরন করেছে মুহাম্মদের মৃত্যুর পরে শত শত বছর ধরে মুহাম্মদের নামে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বানোয়াট হাদীস বানিয়ে।

রাসূলের বাণী শুধুমাত্র কোরানে আছে, কোরানের বাইরে ইসলামে তাঁর কোন বাণী নেই

“কুল/قل/বলুন” শব্দটি কুরআনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দগুলির মধ্যে একটি। এটির অর্থ হল কুরআনে এমন কিছু নির্দিষ্ট বাণী রয়েছে যা সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর রসূলকে আদেশ করেছিলেন মানুষকে বলতে এবং পবিত্র কোরানে “বলুন” শব্দের প্রাচুর্য দ্বারা এই আয়াতগুলিকে আলাদা করা হয়েছে। “বলুন” শব্দ দিয়ে আল্লাহর নিজস্ব বাণী রাসূলের মুখে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। ৩৩২টি কোরানের আয়াতে আদেশ রয়েছে (বলুন…”)। এই আয়াতগুলিতে ইসলামি বিশ্বাস সম্পর্কিত আমাদের প্রশ্নের উত্তর রয়েছে।

কুরআন পড়ে আমরা জানতে পারি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লোক বা গোষ্টি রসূলের কাছে আসত বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে তার সমাধানের জন্য বা ধর্মীয় নির্দেশনার জন্য। রসূল নিজের থেকে কোন নির্দেশনা বা উত্তর না দিয়ে আল্লাহর ওহীর অপেক্ষা করতেন। তার নিজেরই যদি আইন প্রনয়নের ক্ষমতা থাকত, তাহলে নিশ্চয় তিনি ওহীর অপেক্ষা না করে সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নের জবাব বা নির্দেশনা দিয়ে দিতেন। প্রশ্ন উঠতে পারে এটা কিভাবে জানা গেল? এটা জানতে হলে কোরানের কিছু আয়াতের দিকে নজর দেয়া লাগবে, যেগুলো শুরু হয়েছে “তোমাকে জিজ্ঞাসা করে/ইয়াসয়ালুনাকুম …….”, আর শেষ হয়েছে ‘বল/কুল’…..দিয়ে। মানুষের জিজ্ঞাসার জবাবে উত্তরটা কি হবে, তা আয়াতের মাধ্যমে বলে দেয়া হচ্ছে রসূলকে। কিছু নমুনা দেখা যাক:

{৮:১ আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে, গনীমতের হুকুম। বলে দিন, গণীমতের মাল হল আল্লাহর এবং রসূলের। অতএব, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং নিজেদের অবস্থা সংশোধন করে নাও। আর আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের হুকুম মান্য কর, যদি ঈমানদার হয়ে থাক।}

{২:২১৯ তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও, এতদুভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। আর মানুষের জন্যে উপকারিতাও রয়েছে, তবে এগুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়। আর তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, কি তারা ব্যয় করবে? বলে দাও, নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পর যা বাঁচে তাই খরচ করবে। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্যে নির্দেশ সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা করতে পার।}

রাসূল ইচ্ছা করলেই কি পারতেন না নিজের থেকে বলে দিতে, গনীমতের মাল কে কতটুকু পাবে বা মদ খাওয়া খারাপ বা কতটুকু দান করা ভাল? না, তিনি তা না করে আল্লাহর আয়াতের অপেক্ষা করেছেন।

এমনো হয়েছে, কোন একটি বিষয়ে আগেই আয়াত নাযিল হয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরপরে ও মানুষ যখন আবার একি বিষয়ে আবারো প্রশ্ন করেছে, তখন রসূল পারতেন আগের আয়াতগুলো শুনিয়ে দিতে বা নিজের থেকে আগের আয়াতগুলোর উপরে ভিত্তি করে নির্দেশনা দিতে। তিনি তা করেন নি, বরং বরাবরের মতো আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা করেছেন। যেমন এতিমদের উপরে শুরুর দিকে অনেকগুলো আয়াত নাযিল হয়।

{৯৩:৯ সুতরাং আপনি এতীমের প্রতি কঠোর হবেন না; ১০৭:১-২ আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে বিচারদিবসকে মিথ্যা বলে? সে সেই ব্যক্তি, যে এতীমকে গলা ধাক্কা দেয়; ৮৯:১৭ এটা অমূলক, বরং তোমরা এতীমকে সম্মান কর না। ৯০:১৪,১৫ অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে অন্নদান। এতীম আত্বীয়কে; ১৭:৩৪ আর, এতিমের মালের কাছেও যেয়ো না, একমাত্র তার কল্যাণ আকাংখা ছাড়া; }

পরের দিকে আরো কিছু আয়াত নাযিল হয় এতিমদের সাথে কেমন ব্যাবহার করা উচিৎ তার নির্দেশনা দিয়ে।

{৭৬:৮ তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, এতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে। ২:১৭৭ আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্নীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে।}

এরপরেও যখন আবারো এতিমদের নিয়ে মানুষ প্রশ্ন করে তখন রসূল কি পারতেন না আগের আয়াতগুলোর উপর ভিত্তি করে বা নিজের বিবেচনাকে কাজে লাগিয়ে নির্দেশনা দিতে? না, তিনি তা দেন নি। তিনি অপেক্ষা করেছেন আল্লাহর অহীর।

{২:২২০ আর তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, এতীম সংক্রান্ত হুকুম। বলে দাও, তাদের কাজ-কর্ম সঠিকভাবে গুছিয়ে দেয়া উত্তম আর যদি তাদের ব্যয়ভার নিজের সাথে মিশিয়ে নাও, তাহলে মনে করবে তারা তোমাদের ভাই। বস্তুতঃ অমঙ্গলকামী ও মঙ্গলকামীদেরকে আল্লাহ জানেন।}

মুহাম্মদ নিজস্ব বাণী দিয়ে নয়, বরং সতর্ক করেছেন, স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, জেহাদ করেছেন এবং সুসংবাদ নিয়ে এসেছেন শুধুমাত্র কুরআন ব্যবহার করে: “এবং এটি (কুরআন) দিয়ে সতর্ক করুন যারা তাদের পালনকর্তার সামনে সমবেত হওয়ার ভয়…” (৬:৫১); “…এবং এটি (কুরআন) দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিন, যাতে কেউ স্বীয় কর্মে এমন ভাবে গ্রেফতার না হয়ে যায় যে…” (৬:৭০); “. .. অতএব, যে আমার শাস্তিকে ভয় করে, তাকে কোরআনের মাধ্যমে উপদেশ দান করুন।” (৫০:৪৫); “আমরা আপনার ভাষায় এটাকে (কুরআনকে) সহজ করে দিয়েছি, যাতে ধার্মিকদের সুসংবাদ প্রদান করা যায় এবং এর দ্বারা শত্রুদেরকে সতর্ক করা যায়।” (১৯:৯৭); “অতএব আপনি কাফেরদের আনুগত্য করবেন না এবং তাদের সাথে এটা (কুরআন) দিয়ে জেহাদ করুন বড় জিহাদ/جِهَادًا كَبِيرًا “(২৫:৫২)

মানুষ মাত্রই দুর্বল এবং ভুল করে। “মানুষ দুর্বল সৃজিত হয়েছে” (৪:২৮)। মুহাম্মদ ও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নন, কারন মুহাম্মদ আমাদের মতোই মানুষ। “বলুন, আমিও তোমাদের মতই মানুষ..”(৪১:৬)। নবী মুহাম্মদের কিছু কথা এবং কাজ ইসলামী চেতনা থেকে দূরে, কিন্তু কুরআনের মধ্যে লিপিবদ্ধ।

তেমনই একটি গল্প কুরআন থেকে: মুহাম্মাদ বিচারক হিসাবে কিছু বিশ্বাস ঘাতকের পক্ষ নিয়েছিলেন, যদিও তারা ছিল দোষী পক্ষ। কুরআনের এই গল্প থেকে নাম, পরিস্থিতি, অবস্থান ইত্যাদি উপাদানগুলিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এগুলো জানা গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে। ন্যায়বিচার প্রয়োগের ক্ষেত্রে মানুষের দুর্বলতার সমস্যা সম্পর্কে সকল যুগে সকল কুরআন-বিশ্বাসী মানুষকে সংবেদনশীল করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ মুহাম্মদকে কুরআন ব্যবহার করে বিচার করার আদেশ দেওয়ার সময় তাকে তিরস্কার করেছেন এবং যেহেতু তিনি তা ভুলে গেছেন, এজন্য তাকে অবশ্যই আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে : “আমরা আপনার প্রতি সত্য সহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি আল্লাহ আপনাকে যা দেখিয়েছেন সে অনুসারে আপনি মানুষের মধ্যে বিচার করতে পারেন। এবং বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষে বিতর্ককারী হবেন না।। এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। এবং যারা নিজেদেরকে প্রতারণা করে তাদের পক্ষে তর্ক করবেন না। আল্লাহ প্রতারক পাপীকে ভালবাসেন না। … যে কেউ পাপ করে, সে নিজের পক্ষেই করে।.. আপনি বর্তমান জীবনে তাদের পক্ষে তর্ক করছেন, কিন্তু কেয়ামতের দিন তাদের পক্ষে আল্লাহর সাথে কে তর্ক করবে? বা তাদের প্রতিনিধি কে হবে?… যদি আপনার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা না হত, তবে তাদের একদল আপনাকে পথভ্রষ্ট করার সংকল্প করেই ফেলেছিল।…” ( ৪:১০৫-১১৩) এইভাবে, আল্লাহ সেই প্রতারকদের প্রতারণা ও ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ করেছেন এবং ন্যায়বিচারকে সমুন্নত রেখেছেন। একজন বিচারক হিসেবে মুহাম্মদ কুরআনের বাইরে কিছুই ব্যবহার করেননি; প্রত্যেকেই নিজের পাপের জন্য দায়ী এবং শেষ দিনে কেউ কারো পক্ষে সুপারিশ করবে না: “…অপরাধীদের কোন অন্তরঙ্গ বন্ধু থাকবে না এবং আনুগত্য করার জন্য কোন সুপারিশকারী থাকবে না।” (৪০:১৮)।

মুহাম্মদের উপর অবতীর্ণ নূরের অনুসরণ

নশ্বর মুহাম্মাদের উপরে বিশ্বাসের অর্থ হল তার কাছে আল্লাহর ওহী আসে, তার এই দাবীকে বিশ্বাস করা এবং মুহাম্মদের উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে অর্থাৎ কুরআনকে বিশ্বাস করা। “আর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে, সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে মুহাম্মদের প্রতি অবতীর্ণ সত্যে বিশ্বাস করে, আল্লাহ তাদের মন্দ কর্মসমূহ মার্জনা করেন এবং তাদের অবস্থা ভাল করে দেন।” (৪৭:২)। সুতরাং, মুহাম্মাদ নয় বরং তাঁর উপর অবতীর্ণ নূরে অর্থাৎ কুরআনকে ঐশী প্রত্যাদেশ হিসাবে বিশ্বাস করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। “…যারা তাকে বিশ্বাস করে, তাকে সম্মান করে, তাকে সমর্থন করে এবং তার সাথে নেমে আসা আলোকে অনুসরণ করে, শুধুমাত্র তারাই নিজেদের উদ্দেশ্য সফলতা অর্জন করতে পেরেছে।” (৭:১৫৭)।

“… রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। …” (৫৯:৭)

আয়াতের এই খন্ডাংশটুকু মুহাম্মাদীদের খুব পছন্দের। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এই আয়াতের অর্থকে ভুল ব্যাখ্যা করে এবং বিভ্রান্ত করার পরে তারা এটিকে প্রাসঙ্গিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, যাতে তারা কুরআনের পাশে তাদের ধর্মে অন্য যে উৎসগুলি যোগ করেছে, সেগুলিকে জাল বৈধতা এবং জাল বিশ্বাসযোগ্যতা ধার দিতে পারে। মুহাম্মদীরা ভুলভাবে প্রচার করে যে আয়াতের এই খন্ডাংশটি প্রচলিত হাদিসগুলিকে বোঝায়, যেগুলি তারা মুহাম্মদের মৃত্যুর পরে তাঁর নামে আরোপ করেছে। সত্য হল, মুহাম্মদের আদৌ নিজস্ব কোনো হাদিস ছিল না এবং কুরআনের বাইরে ধর্মের কোন উৎস (গুলি) তাঁর কাছে ছিল না।

৫৯:৭ আয়াতের খন্ডাংশটুকুর প্রকৃত অর্থ বোঝার জন্য, বিশেষ করে এই আদেশটি: “… রসূল আপনাকে যা দেন তা গ্রহণ করুন এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাকুন…”, আমাদের অবশ্যই এর কুরআনিক প্রসঙ্গ পড়তে হবে; অর্থাৎ, এর আগে এবং পরে আয়াত/বাক্য। আমরা দেখতে পাই যে ৫৯:৭-৮ আয়াতের বিষয় হল আত্মরক্ষার লড়াই, যুদ্ধ বা লুণ্ঠন থেকে পাওয়া সম্পদ রাজ্যের কোষাগারে পৌঁছানো এবং তা বিতরন। আসুন আমরা এই আয়াতগুলির উপর গভীরভাবে চিন্তা করি: “আল্লাহ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তাঁর রসূলকে যা দিয়েছেন, তা আল্লাহর, রসূলের, তাঁর আত্নীয়-স্বজনের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্যে, যাতে ধনৈশ্বর্য্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়। রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা। এই ধন-সম্পদ দেশত্যাগী নিঃস্বদের জন্যে, যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টিলাভের অন্বেষণে এবং আল্লাহ তাঁর রসূলের সাহায্যার্থে নিজেদের বাস্তুভিটা ও ধন-সম্পদ থেকে বহিস্কৃত হয়েছে। তারাই সত্যবাদী।” (৫৯:৭-৮)।

এই আয়াতদ্বয় কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণীর অভাবীদের মধ্যে অর্থ বণ্টনকেই নির্দেশ করে। তাই, এই আদেশ: “… রসূল আপনাকে যা দেন, তা গ্রহণ করুন এবং তিনি আপনাকে যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাকুন। এই আয়াতের সাথে প্রচলিত হাদীসের দুরতম কোন সম্পর্ক নেই। আমাদেরকে শুধুমাত্র কোরানকেই মেনে চলতে হবে: “আমি আপনার প্রতি সত্য ধর্মসহ কিতাব নাযিল করেছি মানুষের কল্যাণকল্পে।…” (৩৯:৪১)। সুতরাং, আমরা কখনই কুরআনের পাশে কোন অনুমানকৃত উৎস (আখ্যান, ফিকাহ বই, হাদিসের বই ইত্যাদি) বিশ্বাস করব না বা মেনে চলব না।

নবী মুহাম্মদ হলেন প্রথম ব্যাক্তি যিনি রাসূলের আনুগত্য করেন এবং এই রাসূল স্বয়ং ঐশী বার্তা কুরআন

অবশ্যই, মুহাম্মদই ছিলেন প্রথম বিশ্বাসী যিনি কেবলমাত্র কুরআনের প্রত্যাদেশকে মেনে চলেন, যা প্রভু আল্লাহর দিকনির্দেশনা: “আপনার প্রভুর কাছ থেকে আপনার কাছে যে ওহী হয়, তা অনুসরণ করুন…” (৬:১০৬); “এবং আপনার কাছে যা ওহী হয়, তার অনুসরণ করুন এবং সবর কর, যতক্ষণ না হুকুম/ফয়সালা করেন আল্লাহ।.” (১০:১০৯); অতঃপর আমি যখন তা পাঠ করি, তখন আপনি সেই পাঠের অনুসরণ করুন।(৭৫:১৮); “…আমি কেবল আমার মধ্যে যা ওহী করা হয়, তা অনুসরণ করি…” (৪৬:৯); “… আর যখন আপনি তাদের নিকট কোন আয়াত নিয়ে না যান, তখন তারা বলে, আপনি নিজের পক্ষ থেকে কেন অমুকটি নিয়ে আসলেন না, তখন আপনি বলে দিন, আমি তো সে মতেই চলি যে ওহী আসে আমার রবের কাছ থেকে। ..” (৭:২০৩)

আর কত পরিস্কারভাবে বলা সম্ভব যে নবী মুহাম্মদকে শুধুমাত্র কুরআন পৌছে দিতে বলা হয়েছে এবং আমাদের বিশ্বাসীদের সেই কুরআন অনুসরন করতে আদেশ দেয়া হয়েছে!! পড়ুন নিচের আয়াতদ্বয়।

“এটি একটি গ্রন্থ, যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, যাতে করে আপনি এর মাধ্যমে ভীতি-প্রদর্শন করেন। অতএব, এটি পৌছে দিতে আপনার মনে কোনরূপ সংকীর্ণতা থাকা উচিত নয়। আর এটিই বিশ্বাসীদের জন্যে উপদেশ। ৭:২

তোমরা অনুসরণ কর, যা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য সাথীদের অনুসরণ করো না।” ৭:৩

মুহাম্মদ কোন আইনপ্রণেতা ছিলেন না এবং ভবিষ্যতের আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না

প্রকৃত কুরআন-বিশ্বাসী মুসলমানরা এই সত্যে বিশ্বাস করে যে আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব বহন করার জন্য আল্লাহ সঠিক মানুষকে নবী/রসূল হিসেবে বেছে নিয়েছেন: “…তাঁর বার্তা কোথায় রাখতে হবে তা আল্লাহই ভাল জানেন…” (৬:১২৪)। অবশ্যই আল্লাহর বার্তাবাহক/নবীদের জন্য অর্পিত একমাত্র মিশনটি সম্পূর্ণরূপে ঐশী বার্তা পৌঁছে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল: “বার্তাবাহকের (রাসূলের) একমাত্র দায়িত্ব হল পৌঁছে দেওয়া…” (৫:৯৯)। সুতরাং, কুরআনের আয়াতের অর্থ নিয়ে চিন্তা করা মানুষের দায়িত্ব, মুহাম্মদের নয়: “এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি বরকত হিসেবে অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসূহ লক্ষ্য করে এবং বুদ্ধিমানগণ যেন তা অনুধাবন করে।” (৩৮:২৯); “তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা করে না? এটা যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছ থেকে হতো, তাহলে তারা এতে অনেক অমিল পেত।” (৪:৮২); “তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে না? নাকি তাদের অন্তরে তালা লাগানো আছে?” (৪৭:২৪)।

যারা গাফেল যারা কুরআন নিয়ে কখনও চিন্তা করেনি তারা শেষ বিচারের দিনে এটির জন্য বৃথা অনুশোচনা করবে, যখন তাদের আর কিছুই করার থাকবে না এবং তাদের এইভাবে তিরস্কার করা হবে: তারা কি এই কালাম নিয়ে চিন্তা করেনি?…” (২৩:৬৮)। কুরআনের আয়াতগুলি মানুষের জন্য অন্তর্দৃষ্টি এবং এটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা মানুষের দায়িত্ব, মুহাম্মদের নয়: “তোমাদের কাছে তোমাদের প্রভুর কাছ থেকে অন্তর্দৃষ্টিগুলি এসে গেছে। অতএব, যে প্রত্যক্ষ করবে, সে নিজেরই উপকার করবে এবং যে অন্ধ হবে, সে নিজেরই ক্ষতি করবে। আমি তোমাদের পর্যবেক্ষক নই।” (৬:১০৪); “…বলুন, আমি কেবল আমার প্রভুর পক্ষ থেকে আমার প্রতি ওহীর অনুসরণ করি।” এগুলি আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে অন্তর্দৃষ্টি, হেদায়েত এবং বিশ্বাসী লোকদের জন্য রহমত। আর যখন কোরআন পাঠ করা হয়, তখন তাতে মনযোগ দাও এবং নিশ্চুপ থাক যাতে তোমাদের উপর রহমত হয়।” ৭:২০৩-২০৪)।

মুহাম্মদ কোন আইনপ্রণেতা ছিলেন না এবং ভবিষ্যতের আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না

সচরাচর যেমনটি ঘটে থাকে – মানুষ বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে হুজুরদের কাছে যায় ধর্মীয় নির্দেশনা বা ফতোয়া জানতে, তেমনি নবী মুহম্মদের কাছেও তাঁর সমসাময়িকরা বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে আসত। কিন্তু মুহাম্মদ তাৎক্ষনিত নিজের থেকে উত্তর না দিয়ে উত্তরের জন্য আল্লাহর ওহীর অপেক্ষা করতেন। প্রশ্নের উত্তরে কি বলতে হবে তাও আল্লাহ বলে দিয়েছেন। এটা কিভাবে জানা গেল? এটা জানা গেল কুরআনের কিছু আয়াত থেকে, যেখানে মানুষের প্রশ্ন এবং তাঁর উত্তর উভয়ই লেখা আছে। মুহাম্মদের লক্ষ্য ছিল কেবলমাত্র কুরআনের বার্তাটি যেমন আছে তেমনই পৌঁছে দেওয়া এবং নিজের ব্যক্তিগত মতামত দেওয়া নয় বা নিজের থেকে কোন ধর্মীয় আইন প্রণয়ন করা নয়: “তারা নারীদের সম্পর্কে আপনার নির্দেশ জিজ্ঞাসা করে, বলুন: আল্লাহ আপনাকে তাদের সম্পর্কে নির্দেশ দেন…” (৪:১২৭); “মানুষ আপনার নিকট ফতোয়া জানতে চায় অতএব, আপনি বলে দিন, আল্লাহ তোমাদিগকে কালালাহ এর মীরাস সংক্রান্ত সুস্পষ্ট নির্দেশ বাতলে দিচ্ছেন…” (৪:১৭৬)।

মুহাম্মদের কাছে তার সমসাময়িকদের দ্বারা উত্থাপিত প্রশ্ন এবং তাদের কুরআনের উত্তরগুলিতে আমরা নীচের বিষয়গুলি দেখতে পাই।

(ক) তারা মুহাম্মাদকে ধর্মীয় আইন (অর্থাৎ, শরিয়া আইন) সম্পর্কিত নতুন জিনিস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত এবং মুহাম্মদ অপেক্ষা করতেন যতক্ষণ না কুরআনের উত্তর আসে: “তারা আপনাকে গনীমত (الْأَنفَالِ )সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, গনীমত আল্লাহ ও রসূলের জন্য। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং নিজেদের মতভেদ মিটিয়ে ফেল এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য কর, যদি তোমরা মুমিন হও। (৮:১)।

(খ) তারা নবী মুহাম্মাদকে পূর্বে কুরআনে বর্ণিত বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত; আবারও মুহাম্মদ কুরআনের উত্তর না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন। উদাহরণস্বরূপ : বলুন, “আমার পালনকর্তা অনৈতিক কাজ হারাম করেছেন – প্রকাশ্য এবং গোপন উভয়ই …” (৭:৩৩); তথাপি মুহাম্মদকে যখন মদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তখন মদ্যপান একটি পাপ জানা সত্বেও তিনি এই আয়াতে উত্তর দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন: “তারা আপনাকে মদ এবং জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, “তাদের মধ্যে গুরুতর পাপ রয়েছে এবং মানুষের জন্য কিছু সুবিধা রয়েছে, তবে তাদের পাপ তাদের উপকারের চেয়ে বেশি।..” (২:২১৯)।

(গ) এটি লক্ষণীয় যে মুহাম্মদের সমসাময়িকরা যখন তাকে কোরানে উল্লেখিত বিষয়গুলি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল, তখন তিনি একই আয়াতের পুনরাবৃত্তি করেননি; বরং, তিনি অন্যান্য আয়াতের ওহীর জন্য অপেক্ষা করেছিলেন, যা উত্তর নিয়ে এসেছিল। উদাহরণস্বরূপ, এতিমদের যত্ন নেওয়ার বিষয়ে এতগুলো আয়াত (৯৩:৯, ১০৭:১-২, ৮৯:১৭, ৯০:১৫, ১৭:৩৪, ৬:১৫২ এবং ২:১৭৭) থাকার পরেও লোকেরা আবার মুহাম্মদকে এতিমদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল এবং উত্তরগুলি ৪:১২৭ এবং ২:২২০ এ দেওয়া হয়েছে।

মুহাম্মদ কোন আইনপ্রণেতা ছিলেন না এবং ভবিষ্যতের আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না:

ঘ) কেয়ামত কবে হবে, সর্বকালের মুসলমানদের তা জানার আগ্রহ অপরিসীম। কোরানিক সত্য হলো, আমাদের নবীর ভবিষ্যতের কোন জ্ঞান ছিলনা বা কেয়ামতের দিনক্ষন ও জানা ছিলনা। এমনকি তিনি জানতেন ও না, তার বা তার উম্মতের ভবিষ্যত কি? এ ব্যাপারে সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেছেন :

“আপনি বলুনঃ আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডার রয়েছে। তাছাড়া আমি অদৃশ্য বিষয় অবগতও নই। আমি এমন বলি না যে, আমি ফেরেশতা। আমি তো শুধু ঐ ওহীর অনুসরণ করি, যা আমার কাছে আসে।৬:৫০”

“বলুনঃ আমি জানি না তোমাদের প্রতিশ্রুত বিষয় আসন্ন না আমার পালনকর্তা এর জন্যে কোন মেয়াদ স্থির করে রেখেছেন। ৭২:২৫”

অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলে দিনঃ আমি তোমাদেরকে পরিস্কার ভাবে সতর্ক করেছি এবং আমি জানি না, তোমাদেরকে যে ওয়াদা দেয়া হয়েছে, তা নিকটবর্তী না দূরবর্তী। ২১:১০৯”

এবং এর থেকেও পরিস্কার ভাবে আল্লাহ বলেছেন :

” বলুন, আমি তো কোন নতুন রসূল নই। আমি জানি না, আমার ও তোমাদের সাথে কি ব্যবহার করা হবে। আমি কেবল তারই অনুসরণ করি, যা আমার প্রতি ওহী করা হয়। আমি স্পষ্ট সতর্ক কারী বৈ নই। ৪৬:৯”

এত কিছুর পরেও আরো অনেক আয়াত আছে, যেখানে দৃঢ় ভাবে বলা হয়েছে যে কবে কেয়ামত হবে তা শুধু আল্লাহই জানেন।

“নিশ্চয় আল্লাহর কাছেই কেয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। ৩১:৩৪”

“কেয়ামতের জ্ঞান একমাত্র তাঁরই জানা। ৪১:৪৭”

“বরকতময় তিনিই, নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু যার। তাঁরই কাছে আছে কেয়ামতের জ্ঞান এবং তাঁরই দিকে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। ৪৩:৮৫”

উপরের আয়াতগুলো থেকে আমরা নিশ্চিতভাবে জানতে পারি যে, আমাদের নবী ভবিষ্যত জানতেন না এবং কেয়ামত কবে হবে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। যদিও একটি আয়াতই যথেষ্ট ছিল, তবুও মানুষ তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে নবীকে বারে বারে একি প্রশ্ন করতে থাকে। নবী ও যথারীতি উত্তর না দিয়ে ওহীর অপেক্ষা করেন। ফলে প্রতিবারেই ওহীর মাধ্যমে একি উত্তর আসে এই বলে যে, রসূল ভবিষ্যত জানেন না এবং কেয়ামতের দিনক্ষন শুধু আল্লাহই জানেন।

প্রতিবারি যখনি নবীকে কেয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হতো, তিনি পূর্বে নাযিল হওয়া আয়াতের উপর নির্ভর করে নিজের থেকে কোন উত্তর দিতেন না এবং যদিও তিনি জানতেন যে পূর্বে নাযিল হওয়া আয়াতের পরিপন্থি কোন উত্তর আসা সম্ভব না, তবুও তিনি ধৈর্য্যের সাথে ওহীর অপেক্ষা করতেন।

“আপনাকে জিজ্ঞেস করে, কেয়ামত কখন অনুষ্ঠিত হবে? বলে দিন এর খবর তো আমার পালনকর্তার কাছেই রয়েছে। তিনিই তা অনাবৃত করে দেখাবেন নির্ধারিত সময়ে। আসমান ও যমীনের জন্য সেটি অতি কঠিন বিষয়। যখন তা তোমাদের উপর আসবে অজান্তেই এসে যাবে। আপনাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, যেন আপনি তার অনুসন্ধানে লেগে আছেন। বলে দিন, এর সংবাদ বিশেষ করে আল্লাহর নিকটই রয়েছে। কিন্তু তা অধিকাংশ লোকই উপলব্ধি করে না। আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ চান। আর আমি যদি গায়বের কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে পারতাম, ফলে আমার কোন অমঙ্গল কখনও হতে পারত না। আমি তো শুধুমাত্র একজন ভীতি প্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা ঈমানদারদের জন্য। ৭:১৮৭-১৮৮”

মানুষ এই উত্তরে সন্তুষ্ট না। তারা সঠিক দিনক্ষন জানতে চায়। আবারো প্রশ্ন। আবারো অপেক্ষা। উত্তর আসে –

“তারা আপনাকে জিজ্ঞাসা করে, কেয়ামত কখন হবে? এর বর্ণনার সাথে আপনার (মুহম্মদের) কি সম্পর্ক ? এর চরম জ্ঞান আপনার পালনকর্তার কাছে। যে একে ভয় করে, আপনি তো কেবল তাকেই সতর্ক করবেন। ৭৯:৪২-৪৫”

এর পরেও একি প্রশ্ন, কেয়ামত কবে হবে? নবী আগের আয়াতগুলোর উপরে ভিত্তি করে উত্তর দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা না করে আবারো আল্লাহ্‌র নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেন। ওহী আসে – “

লোকেরা আপনাকে কেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, এর জ্ঞান আল্লাহর কাছেই। আপনি কি করে জানবেন যে সম্ভবতঃ কেয়ামত নিকটেই।৩৩:৬৩”

এভাবেই নবীর জীবদ্দশায় বারে বারেই বিভিন্ন মানুষ একি প্রশ্ন করেছে কিন্তু নবী আগে নাযিল হওয়া আয়াতের রেফারেন্স দিয়ে মানুষকে সন্তুষ্ট না করতে পেরে আল্লাহ্‌র ওহীর অপেক্ষা করেছেন এবং বারে বারে একি উত্তর পেয়েছেন। আল্লাহ্‌র বানী তো আর পরিবর্তন হয় না বা পরস্পর বিরোধী আয়াত আসা ও সম্ভব না। তাহলে মানুষকে কিভাবে সন্তুষ্ট করা সম্ভব? কোরানের তো পরিবর্তন সম্ভব না, কারন আল্লাহ নিজেই এর হেফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন। যদিও কোরান থেকে আমরা নিশ্চিতভাবেই জানতে পারি, রসূল ভবিষ্যত জানতেন না এবং কেয়ামতের কোন জ্ঞান তার ছিল না, তারপরেও আমরা রসূলের মৃত্যুর পরে হাদীসের নামে বিভিন্ন বর্ননা পাই – কেয়ামতের লক্ষন কি কি, জান্নাত ও জাহান্নাম বাসীদের হাল হকিকতের বর্ননা, তার উম্মতের ভবিষ্যত নিয়ে বিভিন্ন ভবিষ্যদবানী, যেমন কয় দল হবে, কারা সঠিক পথে থাকবে, কারা শাফায়াত পাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সহীহ হাদিসগ্রন্থগুলো এইধরনের সহীহ হাদীস দিয়ে পূর্ন, যা মানুষকে সন্তুষ্ট করে চলেছে কিন্তু এগুলো পরিস্কার কোরানিক শিক্ষার পরিপন্থি।

এই সকল হাদীস কোরানের মহিমাকে বুঝতে সাহায্য করে, কারন এখন আমরা জানি কেন বারে বারে কেয়ামতের দিনক্ষন ও রসূলের ভবিষ্যত জ্ঞান নিয়ে এতগুলো আয়াত একি উত্তর নিয়ে বিভিন্ন সময়ে এসেছিল।

একটি বা দুটি নয়, এমন শত শত হাদীস আছে যা কেয়ামত ও ভবিষ্যদবানী নিয়ে, যা পরিস্কার কোরানিক শিক্ষার পরিপন্থি। আসলে যারা এ ধরনের হাদীসে বিশ্বাসী তারা কুরআনকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করে। এই ইস্যুতে কোন মধ্যবর্তী বা মাঝামাঝি অবস্থান নেই: হয় কুরআনে বিশ্বাস করার জন্য হাদীসকে অবিশ্বাস করা বা হাদীসে বিশ্বাস করার জন্য কুরআনকে অবিশ্বাস করা। কুরআন এবং হাদিস একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় তাদের উভয়কেই বিশ্বাস করা অসম্ভব। যে কোন একটিকে বেছে নিতে হবে। Choice is yours.

ঙ) মুহাম্মদের সমসাময়িকরা তাঁর কাছে এমন সব প্রশ্ন করতেন, যার উত্তর তাঁর জানা ছিল বা নিজের থেকেই দিয়ে দিতে পারতেন। তবুও, তিনি তার নিজস্ব মতামত দেওয়ার পরিবর্তে পুনরায় কুরআনের আয়াত নাজিলের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। এর উদাহরণ হল যখন তারা তাকে অর্ধচন্দ্র এবং মহিলাদের ঋতুস্রাব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল: “তারা আপনাকে অর্ধচন্দ্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, “এগুলি মানুষের জন্য এবং হজের সময়সূচী।”…” (২:১৮৯)। “এবং তারা আপনাকে ঋতুস্রাব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে: বল, “এটি ক্ষতিকারক, সুতরাং ঋতুস্রাবের সময় মহিলাদের থেকে দূরে থাক। এবং তাদের কাছে যেও না যতক্ষণ না তারা পবিত্র হয়…” (২:২২২)।

(চ) আরো একটি ঘটনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, একজন স্ত্রী তার স্বামী সম্পর্কে মুহাম্মদের কাছে অভিযোগ করেছিলেন এবং মুহাম্মদের সাথে বাদানুবাদ করেছিলেন এবং সন্তুষ্ট না হয়ে নবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন আল্লাহর কাছে : “যে নারী তার স্বামীর বিষয়ে আপনার সাথে বাদানুবাদ করছে এবং অভিযোগ পেশ করছে আল্লাহর দরবারে, আল্লাহ তার কথা শুনেছেন। আল্লাহ আপনাদের উভয়ের কথাবার্তা শুনেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু শুনেন, সবকিছু দেখেন।” (৫৮:১)।

প্রশ্ন উত্তরের এই আয়াতগুলির অর্থ হল ইসলামে আল্লাহই একমাত্র আইন প্রণেতা ও নির্দেশ দাতা, মুহাম্মদ বা অন্য কোন মানুষ নন। ধর্মীয় আইন জারি করার কোন অধিকার মুহাম্মদের ছিল না। ইসলামের ধর্মীয় আইন ও নির্দেশের শুধুমাত্র একটি উৎস আল্লাহর দ্বারা সংরক্ষিত আছে: কুরআন নিজেই। মুহাম্মদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল কোরান প্রচার করা, নিজের মতামত প্রদান করা নয়। কুরআনের বাইরে মুহাম্মদের নামে প্রচলিত এমনকি একটি হাদিসও কখনো মুহাম্মদের থেকে হতে পারে না। একটাও না। এটা একেবারেই অসম্ভব।

মুহাম্মদের ইজতিহাদ ছিল কুরআনের শরিয়া আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে, অতিরিক্ত বা নতুন আইন জারি করার ক্ষেত্রে নয়:

[আল-ইজতিহাদ (الاجتھاد) শব্দটি জুহদুন (جھد) হতে গৃহীত, যার মানে হল প্রচেষ্টা। ইজতিহাদের মানে হল, কোন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য চেষ্টা ও চিন্তা শক্তিকে ব্যয় করা। সুন্নীদের ধর্মগুরু ইমাম গাযালীর মতে, ‘ইজতিহাদ মানে শরীআতের বিধান উদঘাটন করার জন্য ইলম (জ্ঞান) সন্ধান করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করা।’]

মুহাম্মদের একমাত্র ইজতিহাদ ছিল কুরআনে বর্ণীত আল্লাহর আদেশ এবং শরিয়া আইনগুলিকে সর্বোত্তম উপায়ে প্রয়োগ করা। তিনি কোন ধর্মীয় নিয়ম বা আইন উদ্ভাবন করেননি। এমনকি আল্লাহ তাকে তাঁর সমসাময়িক বাসিন্দাদের সাথে তাদের আচরণের ও কাজের ক্ষেত্রে পরামর্শ করার নির্দেশ দিয়েছেন: “… এবং কাজে কর্মে তাদের পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা করুন.. ” (৩:১৫৯)। মুহাম্মদ কোরানের বিধান প্রয়োগ করেছিলেন তার যুগের তার লোকেদের পরিস্থিতি, তাদের অবস্থান ও পরামর্শ বিবেচনায় রেখে। এর মানে হল যে তিনি যেভাবে কোরানের বিধান প্রয়োগ করেছিলেন, সেভাবে পরবর্তী যুগের এবং আমাদের আধুনিক যুগেও প্রয়োগ করার বাধ্যবাধকতা নেই। কারন প্রতিটি যুগে মানুষের নিজস্ব পরিস্থিতি ভিন্ন। আরও ব্যাখ্যার জন্য এই বিষয়টির উদাহরণ দেওয়া যাক। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন: “এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রস্তুত কর যত শক্তি তুমি সংগ্রহ করতে পারো এবং যত অশ্বারোহী সৈন্য সংগ্রহ করতে পারো…” (৮:৬০)। অবশ্যই, আমাদের আধুনিক যুগে অশ্বারোহী সৈন্য এবং ঘোড়া ব্যবহার হয় না। সুতরাং এই আয়াতের প্রয়োগ মুহাম্মদ যেভাবে করেছিলেন সেই ভাবে আধুনিক কালে করলে পাগলামি হবে। এই আয়াত অনুসারে আমাদের যেটা করতে হবে – আমরা যখন আক্রমণাত্মক শত্রুর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার যুদ্ধে লিপ্ত হই তখন যতটা সম্ভব সামরিক শক্তি প্রস্তুত করা। আমাদেরকে নির্দেশনা খুঁজতে গিয়ে আধুনিক গবেষণা পদ্ধতির সাথে কুসংস্কার এবং পূর্ব ধারণা ছাড়াই কুরআন নিয়ে চিন্তা করতে হবে।

“যারা তাদের পালনকর্তার আদেশ মান্য করে, সালাত কায়েম করে; পারস্পরিক পরামর্শক্রমে কাজ করে…(৪২:৩৮)। কুরআনের পাঠ্য বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের ইজতিহাদ অবশ্যই আমাদের পরিস্থীতি বিবেচনায় করতে হবে এবং সেটা করতে গিয়ে ভুল হতেই পারে। কারন সমস্ত মানুষই ভুল করে এবং ভুলের জন্য আমরাই দায়ী। আমাদের অবশ্যই বলতে হবে যে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের, যা কুরআনের আয়াতের উপর আমাদের নিজস্ব চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করে। আমাদের চিন্তাধারা আমাদের জন্য প্রযোজ্য, অতীত বা ভবিষ্যত যুগের জন্য নয়। আল্লাহ শেষ দিন পর্যন্ত কুরআন সংরক্ষণ করেন এবং সে অনুযায়ী সকল যুগের লোকেরা তাদের যুগপযোগি চিন্তাধারার ভিত্তিতে আল্লাহর নির্দেশনা মেনে চলে। এই কুরআনের আয়াতের ভিত্তিতেই আমরা অতীতের ধর্মযাজক, ঈমাম, লেখকদের ভুল মতামত এবং ভুয়া হাদিস প্রমাণ করতে সক্ষম হই।

২:১৪১”…. আল্লাহ তোমাদের কর্ম সম্পর্কে বেখবর নন। সে সম্প্রদায় অতীত হয়ে গেছে। তারা যা করেছে, তা তাদের জন্যে এবং তোমরা যা করছ, তা তোমাদের জন্যে। তাদের কর্ম সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞেস করা হবে না।”

পবিত্র কুরআন বোঝার অন্যতম শর্ত জ্ঞান চর্চা

কুরআন বুঝতে হলে শুধু বিশ্বাস করলে হবে না, জ্ঞান চর্চা ও করা লাগবে ; অর্থাৎ চিন্তা ভাবনা করতে হবে। কোরানের আয়াতগুলি সংক্ষিপ্ত, সুনির্দিষ্ট, এবং একটি স্পষ্ট অর্থ সহ নাযিল হয়েছে। কোরানের আয়াতগুলি একে অপরকে ব্যাখ্যা করে এবং এই সত্যটি আমরা এই আয়াতগুলি থেকে অনুমান করতে পারি: “একটি কিতাব যার আয়াতগুলি নিখুঁত করা হয়েছিল, তারপর বিশদ বর্ণনা করা হয়েছিল এক মহাজ্ঞানী, সর্বজ্ঞ সত্তার পক্ষ হতে” (১১:১); “একটি আরবি কুরআন, কোন ত্রুটি ছাড়া, যাতে তারা ধার্মিক হতে পারে।” (৩৯:২৮); “সব প্রশংসা আল্লাহর যিনি নিজের বান্দার প্রতি এ গ্রন্থ নাযিল করেছেন এবং তাতে কোন বক্রতা রাখেননি।” (১৮:১); “এটি তোমার প্রভুর সরল পথ। আমরা আয়াতগুলোকে বিশদভাবে বর্ণনা করেছি উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্যে” (৬:১২৬); “নিশ্চিত এটি আমার সরল পথ। অতএব, এ পথে চল এবং অন্যান্য পথে চলো না। তা হলে সেসব পথ তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন কর।” (৬:১৫৩); “তারা কি কোরান নিয়ে চিন্তা করে না? এটা যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষ থেকে হতো, তাহলে তারা এতে অনেক অমিল পেত।” (৪:৮২)।

এটা জানার পরে, দুটি প্রশ্ন মনে জাগে: (১) কেন সুন্নী/শিয়া/সুফি ইত্যাদি ঈমাম/পন্ডিতরা কুরআনের আয়াতের অর্থ বিকৃত করে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়েছে? (২) যেহেতু কুরআনের আয়াতগুলো একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক নয় এবং কখনোই ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার জন্য উন্মুক্ত নয়, সেহেতু পণ্ডিতরা কীভাবে তাদের নিজস্ব মতামত/অবস্থান সমর্থন করার জন্য কুরআনের আয়াতগুলোকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন? উভয় প্রশ্নের উত্তর সহজ: এটি তাদের দ্বারা গৃহীত ভুল পদ্ধতি; অর্থাৎ নিজেরা জ্ঞান চর্চা করে কুরআন বোঝার চেষ্টা না করে, তাদের সম্প্রদায়/মতবাদের লেখকদের প্রাচীন মধ্যযুগীয় ইতিহাসের বই, তাফসির, ফিকাহ শাস্ত্র, দলীয় হাদিস অনুসারে কুরআন বোঝার চেষ্টা করে।

এখন যে প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছে তা নিম্নরূপ: প্রাচীন লেখকদের অসঙ্গতি এবং বৈপরীত্যের ফাঁদে না পড়ে কুরআন বোঝার এবং গবেষণা করার সঠিক পদ্ধতি ঠিক কী? প্রকৃতপক্ষে গবেষকদের কোনো পূর্ব দৃষ্টিভঙ্গি, কুসংস্কার বা পছন্দনীয় ধারণা থাকলে চলবে না। এই গবেষণার পদ্ধতিটি কুরআনেই বলা আছে, যা মানুষের দ্বারা রচিত নতুন এবং পুরানো সমস্ত বইয়ের জন্য এবং এমনকি কুরআনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কুরআন নির্দেশিত এটিই সঠিক কুরআনবাদী গবেষণা।

বৈপরিত্য খোঁজা – ৪:৮২ “তারা কি কোরান নিয়ে চিন্তা করে না? পক্ষান্তরে এটা যদি আল্লাহ ব্যতীত অপর কারও পক্ষ থেকে হত, তবে এতো অবশ্যই বহু বৈপরিত্য দেখতে পেত।”

গভীর চিন্তা করা -৪৭:২৪ “তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?”

চিন্তা-ভাবনা করা- ২৩:৬৮ “অতএব তারা কি এই কালাম সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে না? না তাদের কাছে এমন কিছু এসেছে, যা তাদের পিতৃপুরুষদের কাছে আসেনি?”

অন্যান্য সকল ভাষার মতো, আরবি ভাষা হল একটি জীবন্ত ভাষা, যা সময়ের সাথে সাথে বিকশিত এবং পরিবর্তিত হয়েছে। যদি কুরআন না থাকত, তাহলে আরবি ভাষাটি সম্ভবত আরামাইক, সিরিয়াক বা ল্যাটিন ভাষার মতো একইভাবে মারা যেত বা অদৃশ্য হয়ে যেত। মিশরীয় এবং অন্যান্য আরব দেশের আরবি উপভাষাগুলির সাথে কুরআনের অনন্য আরবির কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে আমরা কুরআনের পরিভাষা বোঝার জন্য বাইরের উৎস ব্যবহার করতে পারি না। উদাহরণস্বরূপ, কোরানে সুন্নাহ শব্দের অর্থ আল্লাহর পদ্ধতি, শরিয়া বা পথ: “আল্লাহ নবীর জন্যে যা নির্ধারণ করেন, তাতে তাঁর কোন বাধা নেই পূর্ববর্তীদের ক্ষেত্রেও এটাই ছিল আল্লাহর সুন্নাত (سُنَّةَ)। আল্লাহর আদেশ নির্ধারিত, অবধারিত।”(৩৩:৩৮), যেখানে সুন্নীরা একই শব্দটি ব্যবহার করে তাদের হাদিসগুলি বোঝাতে এবং তারা এই শব্দটিকে ভুলভাবে বর্ণনা করে।

উমাইয়া যুগের বিরোধী ব্যক্তিরা প্রথম ‘নবীর সুন্নাহ’ শব্দটি রাজনীতিতে আমদানি করেছিল উমাইয়া খলিফা এবং গভর্নরদের পরোক্ষভাবে সমালোচনা করার জন্য। ‘নবীর সুন্নাহ’ বলা হতো, যেভাবে মুহাম্মদ ইয়াথ্রেব নগর-রাষ্ট্রকে ন্যায়বিচারের সাথে শাসন করেছিলেন, সেটাকে। শিয়া আলাউয়ীরা যখন বিদ্রোহ উস্কে দিতে এবং উমাইয়াদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার বিদ্রোহীকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়, তখন ব্যানার/স্লোগান ছিল – “নবী মুহাম্মদের পরিবারের একজন শাসক দ্বারা সন্তুষ্টি পরিপূর্ণ হয়।”

কুরআনী পরিভাষা অনুযায়ী ‘উম্মি’ অর্থ বিধর্মী (যাদের তাওরাত বা ইঞ্জিলের জ্ঞান নেই), সেখানে আব্বাসীয় যুগের আরবি এবং আজকের আরবীতে ‘উম্মি’ শব্দের অর্থ “নিরক্ষর”। কুরআনের শব্দ ‘হাদ’ মানে আল্লাহর আইন বা অধিকার, যেখানে সুন্নীরা শব্দটিকে “দণ্ড/শাস্তি” বোঝাতে তৈরি করেছে। এইভাবে পার্থিব, মানবসৃষ্ট ধর্মগুলি মেনে চলাদের ধর্মীয় প্রভাবের কারণে কুরআনে ব্যবহৃত একটি প্রদত্ত শব্দ কখনও কখনও নির্দিষ্ট যুগের মধ্যে আরবীতে বিভিন্ন অর্থ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। যেমন, কুরানের পরিভাষায় ‘ওলী/আউলিয়া’ নশ্বর মানুষ দেবতাদেরকে বোঝায় যাদেরকে মুশরিকরা আল্লাহর সাথে পূজা করত: “… যারা আল্লাহ ব্যতীত অপরকে আউলিয়া (أَوْلِيَاءَ ) গ্রহণ করে রেখেছে এবং বলে যে, আমরা তাদের এবাদত এ জন্যেই করি যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়।..” (৩৯:৩)। তবুও, সুফিরা তাদের সাধু/শেখ/গুরুদের বোঝাতে ‘আওলিয়া’ শব্দটি ব্যবহার করে। আরো একটি বহুল প্রচলিত ও ব্যাবহৃত শব্দ ‘মাওলানা’ কুরআনি পরিভাষায় আল্লাহকেই বোঝায়। “.. তুমিই আমাদের প্রভু(مَوْلَانَا)..।”(২:২৮৬)। তবুও, আমাদের হুজুররা মাওলানা খেতাব দিয়ে নিজদেরকে প্রভু আল্লাহর আসনে বসিয়েছে। তাই কুরআনের পরিভাষা বোঝার জন্য আরবি ভাষার অভিধানের উপর নির্ভর করা যায় না। কুরআনের কোন আরবি শব্দের মানে বাক্যের প্রসঙ্গে এবং অন্য আয়াতে একই শব্দের ব্যাবহারের মাঝে খুঁজতে হবে।

এগুলি হল সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত:

কুরআনের আয়াতগুলি একে অপরের উপর আলোকপাত করে এবং ব্যাখ্যা করে: “যারা আমার নাযিলকৃত সুস্পষ্ট বর্ণনা এবং পথনির্দেশ মানুষের জন্য কিতাবে সুস্পষ্ট করার পরও গোপন করে, তাদের উপর আল্লাহর লানত এবং অভিসম্পাতকারীগণের ও অভিসম্পাত।” (২:১৫৯)। কিতাবকে আল্লাহ নিজেই সুস্পষ্ট করেছেন। আমাদের মানুষদের একটাই কাজ – কিতাব পড়া এবং গভীরভাবে চিন্তা করা। আল্লাহ কুরআন সম্পর্কে নিম্নলিখিত বলেছেন: “আমরা কুরআনকে স্মরণ করার জন্য সহজ করে দিয়েছি। কেউ কি আছে যে স্মরণ করবে?” (৫৪:২২); ধার্মিকদের সুসংবাদ দেওয়ার জন্য এবং শত্রুদেরকে সতর্ক করার জন্য আমরা এটিকে আপনার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি। (১৯:৯৭); “আমরা এটি সহজ করেছি আপনার জিহ্বায়, যাতে তারা মনে রাখতে পারে।” (৪৪:৫৮)।

আহলে কিতাব সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহ তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল: “তোমরা এটা লোকদের কাছে প্রচার করবে, গোপন করবে না।” কিন্তু তারা তাদের পিঠের পিছনে তা ফেলে রাখল এবং সামান্য মূল্যে তা বিনিময় করেছে। কী নিকৃষ্ট বিনিময় তারা করেছে।” (৩:১৮৭)। এই আয়াতটিতে আহলে কিতাবদের অর্থাৎ ইহুদি খৃষ্টানদের কথা বলে আল্লাহ আমাদের, যাদেরকে কুরআন (কিতাব) দেয়া হয়েছে, সাবধান করছেন। আমাদের হুজুররা কি এই সাবধান বাণী স্মরনে রেখেছেন বা এই আয়াত থেকে কোন শিক্ষা নিয়েছেন?

কুরআনের আয়াতগুলি অস্পষ্ট এবং এর ব্যাখ্যার জন্য হাদীসের প্রয়োজন যারা বলে থাকে, কুরআনের এই আয়াত দ্বারা তা খণ্ডন করা হয়েছে: “তারা আপনার কাছে যে যুক্তিই নিয়ে আসুক না কেন, আমরা আপনাকে সত্য এবং আরও ভাল ব্যাখ্যা (তাফসির تَفْسِيرًا ) প্রদান করি।” (২৫:৩৩)। কুরআনের সর্বোত্তম ব্যাখ্যাটি এর পাঠ্যের মধ্যেই রয়েছে, কারণ এর আয়াতগুলি একে অপরের উপর আলোকপাত করে এবং একে অপরের বিশদ বর্ণনা প্রদান করে। কুরআনিক এই সত্যটি এই আয়াত দ্বারা দৃঢ় করা হয়েছে: “…আমরা আপনার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যা সমস্ত কিছুর ব্যাখ্যা এবং হেদায়েত, রহমত ও সুসংবাদ তাদের জন্য যারা আনুগত্য করে।” (১৬:৮৯)। সুতরাং, যেহেতু কোরানের আয়াতগুলি একে অপরকে ব্যাখ্যা করে এবং আমাদের আল্লাহর ধর্ম সম্পর্কে যা জানা দরকার তা স্পষ্টভাবে বলে, সেহেতু কোরানের পাঠে ছলচাতুরী, অপ্রয়োজনীয়তা, শব্দচ্যুতি বা শব্দচয়নের কোন স্থান নেই এবং কুরআনের ‘ব্যাখ্যা’ করার জন্য আমাদের কখনই বাইরের উৎসের প্রয়োজন হয় না। এই আয়াত অনুসারে কুরআনই আমাদের গাইড করার জন্য আল্লাহর রহমতের অংশ। যারা প্রভু আল্লাহর কাছ থেকে নির্দেশনা অন্বেষণ করে আন্তরিকভাবে কুরআন অধ্যয়ন করে, তারা করুণা লাভ করবে এবং হেদায়েত পাবে।

পবিত্র কুরআনের সম্পুর্ন আধিপত্য

কুরআন বুঝতে হলে এটির সম্পুর্ন আধিপত্য মেনে নিয়েই পাঠ করতে হবে, নইলে কুরআনের বাণী থেকে আল্লাহর রহমত পাওয়া যাবে না। কেন? তারই উত্তর খুজব ইসলামে পবিত্র কুরআনের ভূমিকা ও স্থান পরীক্ষার মাধ্যমে। ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থটি কি বিশ্বাসের জন্য একটি বিশদ এবং সম্পূর্ণ দিকনির্দেশনা, নাকি এর জন্য অন্যান্য মনুষ্য রচিত সাহিত্য এবং পরবর্তী অন্যান্য উৎসগুলি থেকে আরও ব্যাখ্যা বা অতিরিক্ত নির্দেশনার প্রয়োজন? এটিই মূল প্রশ্ন, যার উত্তর সমস্ত বিশ্বাসীদের অবশ্যই জানতে হবে।

প্রতিদিন হুজুররা (উলামা এবং ফুকাহাহ) নিরলস প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে বলছে যে, পবিত্র কোরআন বুঝতে এবং তাদের নামাজ রোজা ও অন্যান্য রীতি নীতির অনুশীলন করার জন্য তাদের কুরআন বহির্ভুত হাদীস, তাফসীর প্রয়োজন। আসলেই কি তাই ? প্রথমত, আমাদের হুজুরদের এই ধারণাটি সত্য নাকি মিথ্যা তা নির্ধারণ করতে হবে। যারা দাবি করেন যে,”তোমরা ঘুনাক্ষরেও কোরান বোঝার চেষ্টা করবে না, তাহলে পথভ্রষ্ট হবে। কোরান বুঝতে হলে বিশেষ ‘উলুম’ বা জ্ঞান জানা প্রয়োজন”, তারা কার্যকরভাবে পবিত্র কুরআনকে অস্বীকার করছে এবং তারা পবিত্র কুরআনের একচেটিয়া আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। তারপরে তারা সুচতুরভাবে কুরআনকে প্রতিস্থাপন করেছে তাদের উদ্ভাবিত মনুষ্যনির্মিত হাদীস, পুরুষ-উদ্ভাবিত মধ্যযুগীয় শরিয়াহ আইন এবং হুজুরদের ফাতওয়াহ দিয়ে। দুঃখের বিষয় বেশিরভাগ মুসলমান কুরআন কখনও তাদের নিজের ভাষায় অর্থাৎ যে ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষায় তা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েনি। যদি কেউ কুরআনকে তার সম্পূর্ণরূপে একটি মুক্ত মন দিয়ে বিশ্লেষণ করে, তবে সে অনুধাবন করবে ঐশি গ্রন্থটি কতটা সুস্পষ্ট এবং স্বতন্ত্র। সে খুঁজে পাবে মুসলমান হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য সম্পূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় সকল নির্দেশনা। দুর্ভাগ্যক্রমে, হুজুররা লোকদেরকে সফলভাবে বিশ্বাস করাতে সমর্থ হয়েছে যে, কুরআন অসম্পূর্ণ এবং এর ঘাটতি ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ হাদীস, সন্দেহভাজন শরিয়াহ, প্রাচীনকালের ‘তাফসির’ এবং হুজুরদের ফতওয়াহ ছাড়া গত্যান্তর নেই। তবে এই ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট কুরআনিক আদেশের বিরোধিতা করে। উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহ সূরা আল-নাহলে ১৬:৮৯ এ নিম্নলিখিতগুলি জানিয়েছেন:

{… আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ নাযিল করেছি যেটি এমন যে তা সব কিছুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলমানদের জন্যে সুসংবাদ।}

আয়াতটিতে দ্ব্যার্থহীনভাবে বলা হয়েছে, কুরআন সব কিছুর সুস্পষ্ট বর্ণনা। এর পরে কুরআনের ঘাটতি ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের জন্য রাসুলের মৃত্যুর বহু পরে উদ্ভাবিত প্রশ্নবিদ্ধ হাদীস, সন্দেহভাজন শরিয়াহ, প্রাচীনকালের ‘তাফসির’ এবং ফতওয়াহ ছাড়া গত্যান্তর নেই, হুজুরদের এমন দাবী একটি মিথ্যা মতবাদ ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে বানোয়াট ছাড়া আর কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে, কুরআন জোর দিয়েছে যে এটি সত্য, সম্পূর্ণ এবং বিস্তারিত গ্রন্থ এবং বিকল্প ধর্মীয় নির্দেশনা সন্ধানের জন্য সমস্ত বিশ্বাসীদের তিরস্কার করে। পড়ুন সূরা আল আন-আম ৬:১১৪ নং আয়াত:

{তবে কি আমি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন বিচারক অনুসন্ধান করব, অথচ তিনিই তোমাদের প্রতি বিস্তারিত গ্রন্থ অবতীর্ন করেছেন? আমি যাদেরকে গ্রন্থ প্রদান করেছি, তারা নিশ্চিত জানে যে, এটি আপনার প্রতি পালকের পক্ষ থেকে সত্যসহ অবর্তীর্ন হয়েছে। অতএব, আপনি সংশয়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।}

যেই মাত্র আমরা স্বীকার করব যে পবিত্র কুরআন প্রকৃতপক্ষে পুরোপুরি ব্যাখ্যা সহ নাযিল হয়েছে, তখনই এটা পানির মত পরিস্কার হয়ে যাবে যে আল্লাহর বাণীর ব্যাখ্যার জন্য সম্মিলিত হাদীস বা স্বীকৃত শরিয়াহ মতামত বা সন্দেহজনক মনুষ্যনির্মিত ফাতওয়াহদের প্রয়োজন নেই এবং আমরা এটাও আবিষ্কার করব যে প্রচলিত ধর্মীয় তত্ব ও অনুশীলনগুলি/রিচুয়ালগুলি ইসলামে প্রবেশ করেছে। এটা স্বীকার না করার অর্থই হচ্ছে কুরআনের স্পষ্ট আয়াতকে অস্বীকার করা। অধিকাংশ ইসলামী নেতারা পবিত্র কুরআন সম্পর্কে স্পষ্ট মিথ্যা প্রচার করে থাকে কেবলমাত্র তাদের নিজেদের বিকৃত রীতিনীতি এবং প্রচলিত বিশ্বাসকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য। মনুষ্য নির্মিত উৎসগুলি মোল্লাদের মিথ্যা বেসাতির উপাদান, তারা মিথ্যার চ্যাম্পিয়ন।

যারা ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে কুরআনের সাথে সাথে এই অ-ও অতিরিক্ত-কুরআনিক উৎসগুলির উপর নির্ভর করে, তারা সবাই হাদীস, শরিয়াহ এবং ফাতওয়াহদের অনুমিত প্রয়োজনের প্রমানের জন্য বারবার বলা পুরানো এই অজুহাত নিয়ে আসে: ‘ভাল, আমরা কীভাবে জানব নামাজ কীভাবে পড়তে হবে, আযান কীভাবে দিতে হবে বা কত শতাংশ যাকাত দিতে হবে? তারা জানে এগুলো কুরআনে নেই, যে কারনে এই প্রশ্নগুলি করে থাকে সাধারন মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখার জন্য। এরা সাধারন মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে খেলছে। সাধারন মানুষের ধারনা গত হাজার বছর ধরে তাদের ঈমাম ও হুজুরদের কাছ থেকে তারা যা কিছু উত্তরাধিকার সুত্রে পেয়েছে, তার সবই ইসলাম। কারন সাধারন মানুষ কুরআন পড়ে না বা পড়লেও বোঝার চেষ্টা করে না। ফলে জানেই না, যা কুরআনে নেই তা ইসলাম নয়। সমস্যা হ’ল লোকেরা খুব কমই ধর্মীয় সমাধানের জন্য কুরআনের দিকে নজর রাখে, বরং এটির জন্য ধর্মান্ধ মোল্লাদের উপর নির্ভর করে।

বেশিরভাগ মুসলমান পবিত্র কুরআনকে এক ধরণের রহস্যময় বা সাংকেতিক বই হিসাবে বিবেচনা করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, তাদের ব্রেইন ওয়াশ করা হয়েছে যে মনুষ্যনির্মিত হাদীস, পুরুষালি শরিয়াহ এবং পুরুষ মোল্লা-জারিকৃত ফাতওয়াহদের মতো অন্যান্য সন্দেহজনক উৎসগুলি না জানলে কুরআনে বিবৃত আল্লাহর বাণী উপলব্ধি করা বা বোঝা যাবে না বা বুঝে সেই মতো আমল করলে পাপ হবে। এই কল্পকাহিনীটি সময়ের সাথে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচার করা হয়েছে। স্ব-নিযুক্ত মুসলিম আলেম উলামারা হিটলারের প্রচার মন্ত্রী গোয়েবেলসের কৌশলগুলি অবলম্বন করেছেন, যিনি এই কথাটির জন্য কুখ্যাত: ‘যত বড় মিথ্যা, আপনি যত বেশি পুনরাবৃত্তি করবেন, লোকেরা তত বেশি বিশ্বাস করে’। উলামা ঠিক এভাবেই পুনরাবৃত্তি করেন যে কুরআন কেবল বিশেষজ্ঞ এবং পণ্ডিতদের দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়, সাধারণ মানুষ বা তাদের চিন্তাভাবনা দ্বারা নয়। তাদের এই বিকৃত ব্র্যান্ডের ইসলামকে অন্ধভাবে মেনে চলার মাধ্যমে, বেশিরভাগ মুসলমান আল্লাহর কুরআনে মনোযোগ দেয় না। বেশিরভাগ মুসলমান যুক্তিযুক্ত বিশ্বাসের চর্চায় ইজতিহাদ (বিশ্লেষণাত্মক যুক্তি) প্রয়োগ করেন না, বরং কেবল মোল্লারা যা দাবি করেন তাতে তাকলিদ বা অন্ধ বিশ্বাস করেন।

এটি সত্যিই দুঃখজনক যে, যেখানে বেশিরভাগ মুসলমানের উচিৎ ছিল ধর্মীয় প্রশ্নোত্তরের জন্য প্রথম এবং একমাত্র উৎস কুরআনের পাঠ্যের সাথে পরামর্শ করা, সেখানে তা না করে তারা নির্ভর করে কয়েক হাজার বানোয়াট কাহিনী এবং জালিয়াতি হাদীসে অন্তর্ভুক্ত প্রাচীন শ্রবণশক্তি, স্মরনশক্তি এবং মিথ্যা তথ্যের উপর। এরা সকলে নির্লজ্জভাবে মূল কোরআনের আদেশকে অস্বীকার করে, যে আদেশ এমনকি নবী মুহাম্মদ নিজেও মান্য করতে বাধ্য ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, কুরআনের বাণী নবীকে কেবল তাঁর কাছে যা প্রকাশিত হয়েছিল তা মেনে চলার নির্দেশ দেয় এবং ইসলামের বিধিগুলির ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব খেয়াল খুশি বা ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাগুলির অনুসরণ করতে নিষেধ করে। পড়ুন নিম্নের এই আয়াত ও চিন্তা করুন:

{৬:৫০-“আপনি বলুনঃ আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডার রয়েছে। তাছাড়া আমি অদৃশ্য বিষয় (গায়েব الْغَيْبَ ) অবগতও নই। আমি এমন বলি না যে, আমি ফেরেশতা। আমি তো শুধু ঐ ওহীর অনুসরণ করি, যা আমার কাছে আসে। আপনি বলে দিনঃ অন্ধ ও চক্ষুমান কি সমান হতে পারে? তোমরা কি চিন্তা কর না ?”}

এই আয়াতটি মুসলমানদেরকে বলে যে, নবী নিজেই আল্লাহর আদেশের অধীন ছিলেন এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর স্পষ্ট আদেশ ব্যতীত তাঁর নিজের আইন প্রণয়ন বা উদ্ভাবনের স্বাধীনতা ছিল না। নিজেকে প্রশ্ন করুন কেন এই অনস্বীকার্য কুরআনের আইন আজ মুসলমানদের নজরে আনা হয় না? শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তা করে বলেই কি মুসলমানদেরকে বিনা বাছবিচারে প্রচলিত ধর্মীয় বিধি-বিধান মেনে চলতে হবে? তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাসকে প্রমাণ করার জন্য হুজুরদের আছে অনেকগুলি সন্দেহভাজন এবং চমকপ্রদ হাদিসের গ্রন্থ, যাতে তারা যা পছন্দ করে, তাই রয়েছে। এদের সম্পর্কে আল্লাহ আগেই সাবধান করেছেন:

{৬৮:৩৭-৩৮ “তোমাদের কি কোন কিতাব আছে, যা তোমরা পাঠ কর। তাতে তোমরা যা পছন্দ কর, তাই পাও?}

হুজুররা দাবি করে যে অধিকাংশ লোক তাদের সমর্থন করে, সুতরাং তারা অবশ্যই সঠিক। কিন্তু পবিত্র কোরান ঘোষণা করে যে সংখ্যাগরিষ্ঠরা প্রায়শই ভুল এবং সম্পূর্ণ অনুমান ভিত্তিক কথাবার্তা বলে থাকে। আমরা সূরা আল আন-আম ৬ আয়াত ১১৬ তে এই অসাধারণ কোরানের সত্যতার উল্লেখ পাই:

{৬:১১৬ “আর যদি আপনি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মেনে নেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করে দেবে। তারা শুধু অলীক কল্পনার অনুসরণ করে এবং সম্পূর্ণ অনুমান ভিত্তিক কথাবার্তা বলে থাকে।”}

খুতবা, ওয়াজ মাহফিল, টকশোতে অবিরাম প্রচারের মাধ্যমে বেশিরভাগ মুসলমানের মাথায় ঢুকানো হয়েছে যে, কুরআন বুঝতে শুরু করার আগে তাদের অবশ্যই মনুষ্যসৃষ্ট হাদিস জানতে হবে। তাদের শেখানো হয় যে হাদিস এমন বিষয়গুলিকে স্পষ্ট করে যা কুরআনে বোধগম্য নয়। কিন্তু এই বক্তব্যটিও হাস্যকর শুধুই নয়, কুরআনের একাধিক স্পষ্ট আয়াতের পরিপন্থী। পড়ুন:

{৭:৫২ “আমি তাদের কাছে গ্রন্থ পৌছিয়েছি, যা আমি স্বীয় জ্ঞানে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছি, যা পথপ্রদর্শক এবং মুমিনদের জন্যে রহমত।”}

{৬:১০৫ “এমনিভাবে আমি আয়াত ব্যাখ্যা করি যাতে তারা বলে যে, আপনি তো পড়া শিখে নিয়েছেন (দারস/دَرَسْتَ ) এবং যাতে আমি একে যারা জানে তাদের জন্যে খুব স্পষ্ট করে দেই।”}

{১০:২৪ “…. এমনিভাবে আমি নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করি তাদের জন্য যারা চিন্তা করে।”}

আলোকিত এই কোরানের আয়াতগুলি থেকে এটি স্পষ্ট যে, পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন চিরন্তন ইসলামি সত্যকে পুনঃনিশ্চিত করে যে, আল্লাহ স্বয়ং বিশ্বাসীদের জন্য ঐশী পাঠ্যটি স্পষ্ট করেছেন এবং বিশ্বাসীদের ধর্মীয় নির্দেশনার জন্য কোন সম্পূরক সাহিত্য বা কুরআন বহির্ভুত উৎসের প্রয়োজন নেই। পবিত্র গ্রন্থটি পুনরায় নিশ্চিত করে যে, একমাত্র আল্লাহই প্রত্যাদেশের ব্যাখ্যা এবং বিশদ বর্ণনা করেন, নবী বা তাঁর সাহাবীগণ বা মুসলমানদের প্রথম প্রজন্ম বা পরবর্তী যুগের মোল্লারা নন। অধিকন্তু, পবিত্র কুরআন বেশ স্পষ্ট করে বলেছে যে কুরআন তাদের সকলের জন্য সম্পূর্ণরূপে যথেষ্ট।

{২৯:৫১ “এটাকি তাদের জন্যে যথেষ্ট নয় যে, আমি আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, যা তাদের কাছে পাঠ করা হয়। এতে অবশ্যই বিশ্বাসী লোকদের জন্যে রহমত ও উপদেশ আছে।”}

অধিকাংশ মুসলমান কুরআনের অর্থ না জেনেই পড়েন। কারণ আজকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এটা মেনে নিয়েছে যে, কুরআন এমন একটি গ্রন্থ যা তেলাওয়াত করতে হয় শুধুমাত্র “সোয়াব” অর্জনের জন্য, যদিও কুরআনে কোথাও বলা হয়নি শুধুমাত্র সওয়াব অর্জনের জন্য পাঠ কর। এর ফলে কুরআন তিলাওয়াত/পড়া হয় শুধুমাত্র নামাজ ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাত, মাস, জানাজা ইত্যাদির জন্য। কীভাবে এর শুরু হয়েছিল এবং কী উপায়ে কুরআনকে পিছনে ফেলে হাদিস বা ধর্মীয় পণ্ডিতদের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল এবং লোকেরা কুরআনের পথ থেকে বেরিয়ে এসেছিল, তা একটি দীর্ঘ ইতিহাস। আমরা এখানে সেই ইতিহাস নিয়ে পর্যালোচনা করব না।

কিভাবে আমরা কুরআন বুঝতে এবং অধ্যয়ন করতে পারি

১) ভাষা:

আমরা বেশিরভাগই আরবি ভাষা জানি না, যদিও আমরা কেবল কুরআনের অর্থ না জেনেই কেবল পড়তে জানি (আমিও এই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম)। সুতরাং, যদি আরবি শিখতে পারি তবে ভাল, আর যদি না পারি তবে আমাদের কুরআনের অনুবাদের সন্ধান করা উচিৎ।

ধরে নিচ্ছি আপনি আরবি ভাষা জানেন না। তাই আপনাকে অনুবাদের জন্য যেতে হবে। কিন্তু, বড় প্রশ্ন কোন অনুবাদ? একটি মাত্র আরবি কুরআন থাকলেও একই ভাষায় অসংখ্য অনুবাদ বিদ্যমান রয়েছে। বাংলা ভাষায়, আপনি কম করে হলেও ৬ ধরনের অনুবাদ পাবেন। ইংরেজিতে অনুবাদের সংখ্যা অগণিত। সুতরাং, কেন এটা গুরুত্বপূর্ণ? যেহেতু একটি মাত্র আরবি কুরআন আছে, তাই সব অনুবাদ কি একই হওয়া উচিত নয়? উত্তর হল- ইচ্ছা থাকলেও একই হবে না। এর পেছনের কারণ হল, অনুবাদ মানুষের করা। আর আল্লাহ প্রতিটি মানুষকে ভিন্ন ভাবে সৃষ্টি করেছেন। দুটি মানুষের, এমনকি যমজ ভাই বা বোনের চিন্তা ভাবনা ও এক নয়। যে কারনে দেখা যায় আরবি মাতৃভাষা হলেও একই কুরআন পড়ে দুই জন দুরকম বোঝে, তাফসির করে। মানুষ দলে দলে বিভক্ত এবং প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব আলেম রয়েছে এবং তারা প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব বিশ্বাস অনুসারে কুরআন অনুবাদ করেছে। অন্য কথায় তারা কুরআনের অনুবাদ করে তাদের সত্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। তাই এটা থেকে সাবধান। আপনি নিশ্চিত না হলে অন্তত তিন বা চারটি অনুবাদ চেষ্টা করুন। আর ও ভাল হয় যদি প্রতিটি আরবি শব্দের মানে জানার চেষ্টা করেন।

তবে আমার মনে হয় এত কষ্ট না করলেও চলবে। “আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই ও শির্ক মহা পাপ,যার ক্ষমা নেই” এটা মাথায় রেখে যে কোন অনুবাদ পড়লে আল্লাহ চাহেতো হেদায়েত পাবেন। উপাস্যের তালিকায় আছে নবী রাসূল সহ যে কোন মানুষ, জ্বীন, মালাইকা, পৌরানিক দেবী দেবতা বা কাল্পনিক যে কোন কিছু। এমনিতেই যারা বিশ্বাস করে না, তাদের কানে আছে ছিপি, আর কোরআন তাদের জন্যে অন্ধত্ব। ভাবুন নিচে দেয়া আয়াতগুলো নিয়ে:

{১৩:৩৬_৩৭…. বলুন, আমাকে এরূপ আদেশই দেয়া হয়েছে যে, আমি আল্লাহর দাসত্ব করি। এবং তাঁর সাথে অংশীদার না করি। আমি তাঁর দিকেই দাওয়াত দেই এবং তাঁর কাছেই আমার প্রত্যাবর্তন। এমনিভাবেই আমি এ কোরআনকে আরবী ভাষায় নির্দেশরূপে অবতীর্ণ করেছি।…}

{২০:২-৩ আপনাকে ক্লেশ দেবার জন্য আমি আপনার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করিনি। কিন্তু তাদেরই উপদেশের জন্য যারা ভয় করে।}

{৪১:৪৪ আমি যদি একে অনারব ভাষায় কোরআন করতাম, তবে অবশ্যই তারা বলত, এর আয়াতসমূহ পরিস্কার ভাষায় বিবৃত হয়নি কেন? কি আশ্চর্য যে, কিতাব অনারব ভাষায় আর রসূল আরবী ভাষী! বলুন, এটা বিশ্বাসীদের জন্য হেদায়েত ও রোগের প্রতিকার।যারা বিশ্বাস করে না, তাদের কানে আছে ছিপি, আর কোরআন তাদের জন্যে অন্ধত্ব। তাদেরকে যেন দূরবর্তী স্থান থেকে আহবান করা হয়।}

২) পুরো আয়াতটি পড়ুন:

কুরআনের আয়াত তার প্রসঙ্গ সহকারে পড়ুন, প্রসঙ্গ ছাড়া নয়। বোঝার চেষ্টা করুন আয়াতটি নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠির জন্য নাকি সমগ্র মানব জাতির জন্য, নির্দেশ বা উপদেশ মূলক নাকি শিক্ষামুলক কাহিনি বা বর্ননা ইত্যাদি। কুরআনকে প্রসঙ্গের বাইরে উদ্ধৃত করা এখন পর্যন্ত একক বৃহত্তম ইচ্ছাকৃত ভুল যা শিয়া/সুন্নী ও অন্যান্য ধর্মীয় পন্ডিতরা, ভিন্ন ধর্মের ইসলাম বিদ্বেষীরা, এমনকি নাস্তিকেরা ও করে থাকে নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গিকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য। উদাহরণস্বরূপ, একটি প্রিয় উক্তি যা ইসলাম বিদ্বেষীরা পুনরাবৃত্তি করে এটা প্রমান করার জন্য যে, ইসলাম হত্যা এবং সহিংসতা প্রচার ও সমর্থন করে:

“আর তাদেরকে হত্যাকর যেখানে পাও সেখানেই” (২: ১৯১)।

যাইহোক, যদি আমরা সম্পূর্ণ প্রসঙ্গের পদ্ধতিটি ব্যবহার করি অর্থাৎ পুরো আয়াতটি পড়ি, তাহলে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র ভেসে উঠবে:

{“আর তাদেরকে হত্যাকর যেখানে পাও সেখানেই এবং তাদেরকে বের করে দাও সেখান থেকে যেখান থেকে তারা বের করেছে তোমাদেরকে। বস্তুতঃ ফেতনা ফ্যাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ। আর তাদের সাথে লড়াই করো না মসজিদুল হারামের নিকটে যতক্ষণ না তারা তোমাদের সাথে সেখানে লড়াই করে। অবশ্য যদি তারা নিজেরাই তোমাদের সাথে লড়াই করে। তাহলে তাদেরকে হত্যা কর। এই হল কাফেরদের শাস্তি।”(২:১৯১)}

আরো একটি উদাহরন- হাদিস প্রেমীদের প্রিয় উক্তি:

“… রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। …” (৫৯:৭)

এবার পুরো আয়াত পড়ুন:

{“আল্লাহ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তাঁর রসূলকে যা দিয়েছেন, তা আল্লাহর, রসূলের, তাঁর আত্নীয়-স্বজনের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্যে, যাতে ধনৈশ্বর্য্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়। রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।”(৫৯:৭)}

৩) আগে-পিছের আয়াতগুলি পড়ুন:

কোন আয়াত পড়ে যদি প্রসঙ্গ বা আয়াতটি বোধগম্য না হয়, তাহলে আগের ও পরের আয়াত পড়ুন। তারপরে ও বুঝে না আসলে সূরাটির প্রথম আয়াত থেকে পড়ে আসুন। যদি এমনটি না করা হয় তবে কীভাবে ভুল বোঝাপড়া হয় তার একটি উদাহরণ:

{“আর যখন মূসা তার সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা তোমাদেরই ক্ষতিসাধন করেছ এই গোবৎস নির্মাণ করে। কাজেই এখন তওবা কর স্বীয় স্রষ্টার প্রতি এবং নিজ নিজ প্রাণ বিসর্জন দাও। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর তোমাদের স্রষ্টার নিকট। তারপর তোমাদের প্রতি লক্ষ্য করা হল। নিঃসন্দেহে তিনিই ক্ষমাকারী, অত্যন্ত মেহেরবান।” (২:৫৪)}

এই আয়াতটি আপাতদৃষ্টে অসঙ্গতি তৈরি করে, কারণ মুসা তাঁর লোকদের আত্মহত্যা করতে বলছে যেখানে আল্লাহর আইন অনুসারে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপের মতো শাস্তিযোগ্য (৪:২৯-৩০)। যাইহোক, আমরা যখন ‘বৃহত্তর’ চিত্রটি দেখি যা আয়াতগুলিতে আগে এবং পরে ঘটে তখন গল্পটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে মোড় নেয়:

{“আর যখন আমি মূসার সাথে ওয়াদা করেছি চল্লিশ রাত্রির অতঃপর তোমরা গোবৎস বানিয়ে নিয়েছ মূসার অনুপস্থিতিতে। বস্তুতঃ তোমরা ছিলে যালেম। তারপর আমি তাতেও তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে নাও। আর (স্মরণ কর) যখন আমি মূসাকে কিতাব এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বিধানকারী নির্দেশ দান করেছি, যাতে তোমরা সরল পথ প্রাপ্ত হতে পার। আর যখন মূসা তার সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা তোমাদেরই ক্ষতিসাধন করেছ এই গোবৎস নির্মাণ করে। কাজেই এখন তওবা কর স্বীয় স্রষ্টার প্রতি এবং নিজ নিজ প্রাণ বিসর্জন দাও। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর তোমাদের স্রষ্টার নিকট। তারপর তোমাদের প্রতি লক্ষ্য করা হল। নিঃসন্দেহে তিনিই ক্ষমাকারী, অত্যন্ত মেহেরবান। আর যখন তোমরা বললে, হে মূসা, কস্মিনকালেও আমরা তোমাকে বিশ্বাস করব না, যতক্ষণ না আমরা আল্লাহকে (প্রকাশ্যে) দেখতে পাব। বস্তুতঃ তোমাদিগকে পাকড়াও করল বিদ্যুৎ এবং তোমরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে। তারপর, মরে যাবার পর তোমাদিগকে আমি তুলে দাঁড় করিয়েছি, যাতে করে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে নাও। আর আমি তোমাদের উপর ছায়া দান করেছি মেঘমালার দ্বারা এবং তোমাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছি ’মান্না’ ও সালওয়া’। সেসব পবিত্র বস্তু তোমরা ভক্ষন কর, যা আমি তোমাদেরকে দান করেছি। বস্তুতঃ তারা আমার কোন ক্ষতি করতে পারেনি, বরং নিজেদেরই ক্ষতি সাধন করেছে।(২:৫১-৫৭)}

তার নিদর্শনগুলি প্রকাশ করার জন্য ইস্রায়েলি এই বিশেষ গোষ্ঠীটির মেরে ফেলা ও পুনরুত্থিত করা সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্লান ছিল। সুতরাং, একবার তারা নিজেদের হত্যা করতে অস্বীকার করলে, আল্লাহ তাদের বজ্রাঘাতে মেরে ফেলেন এবং তারপরে তাঁর ইচ্ছা সম্পন্ন করার জন্য তাদের পুনরুত্থিত করলেন। সুতরাং আপাতদৃষ্টে যে অসঙ্গতি তৈরি হয়েছিল তা গোষ্টীটির মৃত্যু ও পুনর্জীবনের মাধ্যমে দুর হয়েছে। আল্লাহ একমাত্র তিনিই, যিনি জীবন নিতে পারেন আবার ফিরিয়ে দিতেও পারেন।

৪) একই আরবি শব্দের একাধিক অর্থ সম্পর্কে সচেতন হন:

কুরআনে কিছু আরবি শব্দ আয়াতের প্রসঙ্গ অনুযায়ী একাধিক অর্থ বহন করে। সুতরাং ‘ভুল’ অর্থ বেছে নিলে কখনও কখনও আয়াতগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করতে পারে বা আয়াতটি যে বিষয়টিকে সম্বোধন করছে সেটির একটি অদ্ভুত বোঝাপড়া দিতে পারে।

এই জাতীয় ক্ষেত্রে পরামর্শটি হ’ল প্রাপ্ত সর্বোত্তম অর্থ অনুসরণ করা:

{যারা মনোনিবেশ সহকারে কথা শুনে, অতঃপর যা উত্তম, তার অনুসরণ করে। তাদেরকেই আল্লাহ সৎপথ প্রদর্শন করেন এবং তারাই বুদ্ধিমান।(৩৯:১৮)}

এমনই একটি বহু-অর্থপূর্ণ শব্দের একটি স্পষ্ট উদাহরণ হ’ল ‘দারবা’ শব্দটি যা ৪:৩৪ আয়াতে আছে এবং এটি মূলত ‘প্রহার/আঘাত করা’ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। শব্দার্থের ভুল প্রয়োগ কীভাবে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে সেটা আমরা দেখতে পাই, যখন দেখি মুসলমান দাবিদাররা বউ পেটায় ধর্মীয়ভাবে জায়েজ করে। এই পোস্টটি পড়তে পারেন – http://faruk55kw.blogspot.com/2011/04/blog-post_25.html

‘দারবা’ শব্দের আরবিতে কমপক্ষে ৬টি অর্থ রয়েছে এবং এসবগুলোই কুরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে পাওয়া যায়:

{“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন আল্লাহর পথে সফর কর (দারাবতুম ضَرَبْتُمْ), তখন যাচাই করে নিও এবং যে, তোমাদেরকে সালাম করে তাকে বলো না যে, তুমি মুসলমান নও। তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদ অন্বেষণ কর, বস্তুতঃ আল্লাহর কাছে অনেক সম্পদ রয়েছে। তোমরা ও তো এমনি ছিলে ইতিপূর্বে; অতঃপর আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। অতএব, এখন অনুসন্ধান করে নিও। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের কাজ কর্মের খবর রাখেন।” (৪:৯৪)}

{“ফেরেশতা যখন তাদের মুখমন্ডল ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে করতে (ইয়াদরিবুনা يَضْرِبُونَ) প্রাণ হরণ করবে, তখন তাদের অবস্থা কেমন হবে?” (৪৭:২৭)}

{“তখন আমি কয়েক বছরের জন্যে গুহায় তাদের কানের উপর নিদ্রার পর্দা ফেলে দেই(দারাবনা فَضَرَبْنَا)।”(১৮:১১)}

{“তোমরা সীমাতিক্রমকারী সম্প্রদায়-এ কারণে কি আমি তোমাদের কাছ থেকে কোরআন প্রত্যাহার করে নেব (নাদরিব أَفَنَضْرِبُ) ?” (৪৩:৫)}

{“তুমি কি লক্ষ্য কর না, আল্লাহ তা’আলা কেমন উপমা বর্ণনা করেছেন(দারাবা ضَرَبَ) পবিত্র বাক্য হলো পবিত্র বৃক্ষের মত। তার শিকড় মজবুত এবং শাখা আকাশে উত্থিত। (১৪:২৪)}

{“খয়রাত ঐ সকল গরীব লোকের জন্যে যারা আল্লাহর পথে আবদ্ধ হয়ে গেছে-জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র ঘোরাফেরা

(দারাবান ضَرْبًا) করতে সক্ষম নয়। অজ্ঞ লোকেরা যাঞ্চা না করার কারণে তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে। তোমরা তাদেরকে তাদের লক্ষণ দ্বারা চিনবে। তারা মানুষের কাছে কাকুতি-মিনতি করে ভিক্ষা চায় না। তোমরা যে অর্থ ব্যয় করবে, তা আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই পরিজ্ঞাত।” (২:২৭৩)}

এমনই আরেকটি শব্দ ‘কালব قَلْبٌ’। এর মানে কখনো হৃদয়, কখনো অন্তর, কখনো ফিরিয়ে দেয়া, ঘুরিয়ে দেয়া, ত্যানা পেচানো ইত্যাদি। দেখুন ২৮:১০; ২:৯৭; ১৭:৩৬; ২৬:৮৯; ১৬:১০৬……শব্দটি কুরআনে ১৬৮ বার এসেছে ৯ রকমে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ নিয়ে। এরকম আরো শব্দ আছে কুরআনে।

৫) একই বিষয়ের আয়াতগুলো একসাথে সাজান (তারতিল):

কুরআন অধ্যয়নের কেন্দ্র বিন্দু হ’ল কোন একটি বিষয়ের অর্থ সন্ধানের জন্য কুরআন আয়াতগুলি সাজানোর ক্ষমতা।

কুরআন নিজেই ‘রাত্তিল’ নির্দেশের অধীনে এই ভাবে কুরআন অধ্যয়নের জন্য বলে:

{“রাত্রিতে দন্ডায়মান হোন কিছু অংশ বাদ দিয়ে, অর্ধরাত্রি অথবা তদপেক্ষা কিছু কম অথবা তদপেক্ষা বেশী এবং কোরআন বিন্যাস (অধ্যায়ন) করুন সুবিন্যস্ত ভাবে (وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا)। (৭৩:২-৪)}

‘রাত্তিল’ একটি আরবি শব্দ যার অর্থ: ‘মিলের বিষয়গুলি একসাথে সাজানো’। অতএব, আমরা যদি কুরআনে কোনও বিষয় গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে চাই, তবে আমরা সেই বিষয়গুলির বিষয়ে কথা বলে এমন সমস্ত আয়াতগুলি গ্রহণ করব, যা পুরো বই জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এবং ‘তাদের একসাথে সাজিয়ে নিব’ (তার্তিল)।

অনুরূপ আয়াত সাজানোর উদাহরণ:

বিবাহবিচ্ছেদ/তালাক’ এর উদাহরণের দিকে তাকিয়ে আমরা দেখতে পাই যে বিষয়টি তিনটি পৃথক অধ্যায় সূরা বাকারা (২), আল আহযাব (৩৩) ও আত তালাক (৬৫) এ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, যা একসাথে স্থাপন করলে বিবাহবিচ্ছেদ সম্পর্কিত আইন ও নির্দেশগুলির একটি সম্পূর্ণ চিত্র সামনে আসে।

{“যারা নিজেদের স্ত্রীদের নিকট গমন করবেনা বলে কসম খেয়ে বসে তাদের জন্য চার মাসের অবকাশ রয়েছে অতঃপর যদি পারস্পরিক মিল-মিশ করে নেয়, তবে আল্লাহ ক্ষামাকারী দয়ালু। আর যদি তালাকের সংকল্প করে নেয়, তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী ও জ্ঞানী। তালাকপ্রাপ্ত মহিলারা নিজেদের জন্য তিন মাসিকের জন্য অপেক্ষা করবে। আল্লাহ তাদের গর্ভে যা সৃষ্টি করেছেন তা লুকিয়ে রাখা তাদের জন্য বৈধ নয়, যদি তারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে। এবং তাদের স্বামীদের সেই সময়ের মধ্যে তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার উত্তম অধিকার রয়েছে, যদি তারা পুনর্মিলন চায়। এবং নারীদের অধিকার থাকবে তাদের উপর, ন্যায়সঙ্গত অধিকার; কিন্তু পুরুষদের তাদের উপর একটি ডিগ্রী (সুবিধা/دَرَجَةٌ) আছে, আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। বিবাহবিচ্ছেদ শুধুমাত্র দুইবার অনুমোদিত: এর পরে, পক্ষগুলি হয় ন্যায়সঙ্গত শর্তে একসাথে থাকবে অথবা হৃদ্যতার (بِإِحْسَانٍ ) সাথে আলাদা হবে। তোমাদের (পুরুষদের) জন্য তোমাদের কোন উপহার (স্ত্রীর কাছ থেকে) ফিরিয়ে নেওয়া বৈধ নয়, তবে উভয় পক্ষ যদি ভয় করে যে তারা আল্লাহর নির্ধারিত সীমা রক্ষা করতে পারবে না। যদি আপনি সত্যিই ভয় পান যে তারা আল্লাহর নির্ধারিত সীমা রক্ষা করতে অক্ষম হবেন, তবে যদি সে তার স্বাধীনতার জন্য কিছু ফিরিয়ে দেয় তবে তাদের উভয়েরই কোন দোষ নেই। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। সুতরাং কেউ যদি আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে সে জালেম। তাই এরপরেও যদি একজন তার স্ত্রীকে তালাক দেয়, তাহলে তিনি তাকে পুনরায় বিয়ে করতে পারবেন না যতক্ষণ না তিনি অন্য একজনকে বিয়ে করেন এবং তিনি তাকে তালাক না দেন। সেক্ষেত্রে তাদের কারোরই কোন দোষ নেই যদি তারা পুনরায় একত্রিত হয় এবং তবে তারা মনে করে যে তারা আল্লাহর নির্ধারিত সীমা রক্ষা করতে পারবে। এগুলি আল্লাহর নির্ধারিত সীমা, যা তিনি যারা বোঝে তাদের জন্য স্পষ্ট করে দেন। আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়ে দাও, অতঃপর তারা নির্ধারিত ইদ্দত সমাপ্ত করে নেয়, তখন তোমরা নিয়ম অনুযায়ী তাদেরকে রেখে দাও অথবা সহানুভুতির সাথে তাদেরকে মুক্ত করে দাও। আর তোমরা তাদেরকে জ্বালাতন ও বাড়াবাড়ি করার উদ্দেশ্যে আটকে রেখো না। আর যারা এমন করবে, নিশ্চয়ই তারা নিজেদেরই ক্ষতি করবে। আর আল্লাহর নির্দেশকে হাস্যকর বিষয়ে পরিণত করো না। আল্লাহর সে অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর, যা তোমাদের উপর রয়েছে এবং তাও স্মরণ কর, যে কিতাব ও জ্ঞানের কথা তোমাদের উপর নাযিল করা হয়েছে যার দ্বারা তোমাদেরকে উপদেশ দান করা হয়। আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ যে, আল্লাহ সর্ববিষয়েই জ্ঞানময়। আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়ে দাও এবং তারপর তারাও নির্ধারিত ইদ্দত পূর্ন করতে থাকে, তখন তাদেরকে পূর্ব স্বামীদের সাথে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নিয়মানুযায়ী বিয়ে করতে বাধাদান করো না। এ উপদেশ তাকেই দেয়া হচ্ছে, যে আল্লাহ ও কেয়ামত দিনের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে। এর মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে একান্ত পরিশুদ্ধতা ও অনেক পবিত্রতা। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।” (২:২২৬-২৩২)}

{“মুমিনগণ! তোমরা যখন মুমিন নারীদেরকে বিবাহ কর, অতঃপর তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দিয়ে দাও, তখন তাদেরকে ইদ্দত পালনে বাধ্য করার অধিকার তোমাদের নাই। অতঃপর তোমরা তাদেরকে উপহার দেবে এবং উত্তম পন্থায় বিদায় দেবে।”(৩৩:৪৯)}

{“হে নবী, তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে চাও, তখন তাদেরকে তালাক দিয়ো ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং ইদ্দত গণনা করো। তোমরা তোমাদের পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করো। তাদেরকে তাদের গৃহ থেকে বহিস্কার করো না এবং তারাও যেন বের না হয় যদি না তারা কোন সুস্পষ্ট নির্লজ্জ কাজে লিপ্ত হয়। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমালংঘন করে, সে নিজেরই অনিষ্ট করে। সে জানে না, হয়তো আল্লাহ এই তালাকের পর কোন নতুন উপায় করে দেবেন।

অতঃপর তারা যখন তাদের ইদ্দতকালে পৌঁছে, তখন তাদেরকে যথোপযুক্ত পন্থায় রেখে দেবে অথবা যথোপযুক্ত পন্থায় ছেড়ে দেবে এবং তোমাদের মধ্য থেকে দু’জন নির্ভরযোগ্য লোককে সাক্ষী রাখবে। তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাক্ষ্য দিবে। এতদ্দ্বারা যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাকে উপদেশ দেয়া হচ্ছে। আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে নিস্কৃতির পথ করে দেবেন। এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিযিক দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্যে একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন। তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যাদের ঋতুবর্তী হওয়ার আশা নেই, তাদের ব্যাপারে সন্দেহ হলে তাদের ইদ্দত হবে তিন মাস। আর যারা এখনও ঋতুর বয়সে পৌঁছেনি, তাদেরও অনুরূপ ইদ্দতকাল হবে। গর্ভবর্তী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তানপ্রসব পর্যন্ত। যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন। এটা আল্লাহর নির্দেশ, যা তিনি তোমাদের প্রতি নাযিল করেছেন। যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার পাপ মোচন করেন এবং তাকে মহাপুরস্কার দেন। তোমরা তোমাদের সামর্থ অনুযায়ী যেরূপ গৃহে বাস কর, তাদেরকেও বসবাসের জন্যে সেরূপ গৃহ দাও। তাদেরকে কষ্ট দিয়ে সংকটাপন্ন করো না। যদি তারা গর্ভবতী হয়, তবে সন্তানপ্রসব পর্যন্ত তাদের ব্যয়ভার বহন করবে। যদি তারা তোমাদের সন্তানদেরকে স্তন্যদান করে, তবে তাদেরকে প্রাপ্য পারিশ্রমিক দেবে এবং এ সম্পর্কে পরস্পর সংযতভাবে পরামর্শ করবে। তোমরা যদি পরস্পর জেদ কর, তবে অন্য নারী স্তন্যদান করবে (৬৫:১-৬)}

বিবাহবিচ্ছেদের এই উদাহরণে দেখানো হয়েছে সমস্ত সম্পর্কিত আয়াতের পরীক্ষা করার সহজ ধাপটি এবং এই উপসংহারে আসা যায় যে, তালাকের এই পদ্ধতি আজও যে কোন আধুনিক এবং সুশীল সমাজে প্রয়োগ করা যেতে পারে এবং এর চেয়ে মানবিক, শান্তির বাণী আর হতে পারে না।

৬) কুরআনে উদাহরণ দেখুন:

একবার কোন একটি আয়াতের বা শব্দের অর্থ বের করা হলে, চূড়ান্ত নির্ভুলতা পরীক্ষা হল কুরআনের সাথে সম্পর্কিত গল্পগুলির সাথে এই ধরনের অর্থের তুলনা করা, যদি এমন একটি গল্প পাওয়া যায়। কারণটি হল যে কুরআনে সম্পর্কিত গল্পগুলি আমাদের জন্য প্রাক্টিক্যাল শিক্ষা। কুরআনের গল্পগুলো কোন উদ্দেশ্য ছাড়া বা কেবল আমাদের বিনোদনের জন্য সেখানে বলা হয়নি।

{আমি তোমার নিকট উত্তম কাহিনী বর্ণনা করেছি, যেমতে আমি এ কোরআন তোমার নিকট অবতীর্ণ করেছি। তুমি এর আগে অবশ্যই এ ব্যাপারে অনবহিতদের অন্তর্ভূক্ত ছিলে। (১২:৩)}

{তাদের কাহিনীতে বুদ্ধিমানদের জন্য রয়েছে প্রচুর শিক্ষণীয় বিষয়, এটা কোন মনগড়া কথা নয়, কিন্তু যারা বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের জন্যে পূর্বেকার কালামের সমর্থন এবং প্রত্যেক বস্তুর বিবরণ রহমত ও হেদায়েত।(১২:১১১)}

৭) ধৈর্য ধরুন এবং আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করুন:

এমনকি আমাদের সমস্ত দক্ষতা এবং জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও, যদি আল্লাহর সাহায্যের জন্য প্রার্থনা না করা হয় তবে কিছুই সঠিক বুঝে আসবে না, হেদায়েত পাওয়া যাবে না। সর্বোপরি, তিনি সকল বিষয়ে, বিশেষ করে ধর্মীয় ব্যাপারে মানবজাতির চূড়ান্ত শিক্ষক।

{“অতএব, যখন আপনি কোরআন পাঠ করেন তখন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করুন।” (১৬:৯৮)}

{“আর যদি আপনি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মেনে নেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করে দেবে। তারা শুধু অলীক কল্পনার অনুসরণ করে এবং সম্পূর্ণ অনুমান ভিত্তিক কথাবার্তা বলে থাকে।” (৬:১১৬)}

{“আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।” (১:৫)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *