ইবাদত

ভূমিকা:
মহাগ্রন্থ আল-কুর’আনের বিখ্যাত আয়াত:

وَمَاخَلَقْتُ ٱلْجِنَّ وَٱلْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ ৫১:৫৬

আর আমি জিন ও মানুষ সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য।

And I did not create the jinn and mankind except to worship Me.
এবং

وَمَآ أُمِرُوٓا۟ إِلَّا لِيَعْبُدُوا۟ ٱللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤْتُوا۟ ٱلزَّكَوٰةَ ۚ وَذَٰلِكَ دِينُ ٱلْقَيِّمَةِ {৯৮:৫}

তাদেরকে এ ছাড়া অন্য কোন হুকুমই দেয়া হয়নি যে, তারা শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে দীনকে একনিষ্ঠ করে; এবং সালাত কায়েম করবে ও পবিত্র হবে; আর এটাই সঠিক দীন। {৯৮:৫}

And they were not commanded except to worship Allah, [being] sincere to Him in religion, inclining to truth, and to establish prayer and to give zakāh. And that is the correct religion.

এই দু’টি আয়াত পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়- জিন ও মানুষের সৃষ্টির উদ্দেশ্য শুধুমাত্র ‘আল্লাহর ইবাদত’ করা। এখানে ‘ইল্লা’ শব্দটি বাংলা ভাষায় ‘শুধুমাত্র’ দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। যা সুস্পষ্টভাবে বোঝায় যে- জিন ও মানুষ ‘আল্লাহর ইবাদত’ ছাড়া আর কোনও কিছু করতে পারে না। তাদেরকে শুধুই ইবাদত করতে হবে।

যদি জিন ও মানুষ আল্লাহর ইবাদতের বাইরে কিছু করতে পারে- তাহলে কুর’আনের আয়াতের দাবি কিন্তু ভুল হয়ে যায়! তবে, তা কখনোই সম্ভব না। মহাগ্রন্থের প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য সত্য ও যথার্থ।

মানুষের অনুবাদ ও বিশ্লেষণে ভুল হতে পারে- কিন্তু মহাগ্রন্থ এবং তাতে উল্লেখিত আল্লাহর প্রতিটি বিবৃতি, দাবি ও প্রতিশ্রুতি একমাত্র সত্য বিষয়। দুটি আয়াতে আল্লাহর বিবৃতি অনুযায়ী মানুষ শুধুমাত্র ‘আল্লাহ্‌র ইবাদত করবে’। এ কথাই ঘোষণা করা হয়েছে।

তাহলে লিয়া’বুদুন (لِيَعْبُدُونِ) বা ইবাদত-এর অর্থ কী? ইবাদত অর্থ যদি সালাত, সাওম, হজ, যাকাত অর্থাৎ মুসলমানদের প্রচলিত প্রার্থনাপদ্ধতি হয়; তাহলে অমুসলিমরা তা মানছে না। এমনকি সব মুসলমানও তা মানছে না।

বাস্তবতা হলো- আল্লাহর উদ্দেশ্যকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কারও নেই। মহান পরাক্রমশালী প্রভু যাকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন- তাকে তা-ই করতে হবে।

…আর সূর্য, চাঁদ, তারকারাজি তাঁর নির্দেশের অনুগত; নিঃসন্দেহে তাঁর সৃষ্টির প্রতি শুধু তাঁরই নির্দেশ; মহিমাময় আল্লাহ জগত-সমূহের রব (লালন-পালন-রক্ষাকর্তা)। {৭:৫৪}
তাহলে সুস্পষ্ট এই বিভ্রান্তির ব্যাখ্যা কী হতে পারে? এ প্রবন্ধে তা উদঘাটন করা হবে।

পর্যবেক্ষণ ১:

إِلَّا لِيَعْبُدُونِ ইল্লা লি-ইয়া’বুদুন- ইয়া’বুদ ছাড়া আর কিছু নয়..
এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি শব্দ হলো- ইল্লা- إِلَّا…। এই শব্দটির আরও কিছু সুস্পষ্ট ব্যবহার দেখা যাক।

يُخَادِعُونَاللَّهَ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّا أَنفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ {২:৯}

তারা আল্লাহ ও বিশ্বাসীদের ধোঁকা দিতে চায়; এবং তারা শুধুমাত্র নিজেদেরকেই প্রতারিত করে- কিন্তু উপলব্ধি করে না। {২:৯}

যখন ইল্লা/ إِلَّا বলা হয়- তখন শুধুমাত্র সেই কাজটার কথাই বোঝানো হয়। যেমন আমরা আরও দেখি।

….وَمَآ أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذْنِ ٱللَّهِ ۚ {৪:৬৪}

আল্লাহর নির্দেশে শুধু আনুগত্য করার জন্যই আমরা রসুলদের পাঠিয়েছি… {৪:৬৪}

يَوْمَ يَقُومُ ٱلرُّوحُ وَٱلْمَلَـٰٓئِكَةُ صَفًّا ۖ لَّا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحْمَـٰنُ وَقَالَ صَوَابًا {৭৮:৩৮}

সেদিন রুহ ও মালাইকা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে; সেদিন কেউ কথা বলবে না, শুধুমাত্র রহমান যাকে অনুমতি দেবেন সে ছাড়া এবং সে সঠিক কথা বলবে। {৭৮:৩৮}
এখানে ইল্লা/ إِلَّا দিয়ে শুধু নিজেদের {২:৯} শুধু আনুগত্য করা {১৪:৪} এবং শুধু যাকে অনুমতি দেওয়া হবে {৭৮:৩৮}– তাকেই বোঝানো হচ্ছে।

এ অবস্থায় {৫১:৫৬} নং আয়াতেও জিন ও মানুষ সৃষ্টির শুধুমাত্র একটাই উদ্দেশ্য ও কর্ম—লি-ইয়া’বুদুন বা ইবাদত (সরল উচ্চারণ) বোঝানো হয়েছে।

আলোচনার স্বার্থে এবং সঠিক অর্থ বোঝার জন্য আমরা ‘ইবাদত’ শব্দের অর্থ পরবর্তীতে বোঝার চেষ্টা করবো।

যেমনটি আগেই বলা হয়েছে- আল্লাহর উদ্দেশ্যকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কারও নেই। মহান পরাক্রমশালী প্রভু যাকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন- তাকে সে কাজই করতে হবে। তাহলে সব মানুষ কীভাবে ইবাদত করছে?

আমরা বিশ্বাস করি, মহান রবের মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য যথাযথই আছে; শুধুমাত্র আমরাই কুর’আন থেকে বহু দূরে সরে গেছি। এ কারণেই বিচার দিবসে মোহাম্মদ রসুলাল্লাহ বলবেন- ‘হে প্রভু! আমার লোকেরাই এই কুর’আনকে পরিত্যাগ করেছিল।’ {২৫:৩০}

পর্যবেক্ষণ ২:

কিয়ামতে দিবসে হজরত ঈসা বলবেন-

إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ ۖ وَإِن تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ {৫:১১৮}

আপনি যদি তাদেরকে শাস্তি দেন- তারা তো আপনারই ইবাদ (দাস-বান্দাহ); আর যদি তাদেরকে ক্ষমা করেন- নিঃসন্দেহে আপনিই মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাবান। {৫:১১৮}

If You should punish them – indeed they are Your servants; but if You forgive them – indeed it is You who is the Exalted in Might, the Wise.”

قُل لِّعِبَادِىَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ يُقِيمُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُنفِقُوا۟ مِمَّا رَزَقْنَـٰهُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَةً مِّن قَبْلِ أَن يَأْتِىَ يَوْمٌ لَّا بَيْعٌ فِيهِ وَلَا خِلَـٰل {১৪:৩১}ٌ

আমার ইবাদ (বান্দাহ)-দের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে তাদের বলো- সালাত কায়েম করতে এবং আমরা তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করতে—সে দিনের আগে, যেদিন কেনাবেচা হবে না- বন্ধুত্বও থাকবে না। {১৪:৩১}

Tell My servants who have believed to establish prayer and spend from what We have provided them, secretly and publicly, before a Day comes in which there will be no exchange nor any friendships.

এখানে এমন ইবাদি/ইবাদুকা (বিশেষ্য পদ) দিয়ে দুই দল মানুষের কথা বলা হচ্ছে- একদল ঈমান এনেছে- আরেক দল ঈমান আনে নি।

দু’টি আয়াতেই একই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বোঝা যাচ্ছে- যারা আল্লাহর প্রার্থনা করে শুধু তারাই ইবাদ নয়। তারাও ইবাদ- যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে- অর্থাৎ মুসলিম নয়- তারাও!

অর্থাৎ সব মানুষই আল্লাহর ইবাদ- ইবাদুল্লাহ।

উল্লেখ্য,
যারা ঈমানদার বা বিশ্বাসী তাদের বাইরে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে আল্লাহ বিভিন্নভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি নিজেই বলছেন- আহলুল কিতাব, আল্লাযিনা হাদু, আল্লাযিনা আমানু, মুজরিমুন, নাসারা, মাজুস, সাবেয়ি ইত্যাদি।

যারা মুসলমান, যারা ইহুদি, সাবেয়ি, খ্রিষ্টান, অগ্নিউপাসক এবং যারা শিরক করেছে, নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবেন; নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু প্রত্যক্ষকারী। {২২:১৭}

এরকম আরও আয়াতে (সুরা বাকারা ৬২; মায়েদা ৬৯) ঈমানদারদের সঙ্গেই ইহুদি, নাসারা, সাবেয়িনদের কথা উল্লেখ করেছেন রব্বুল আলামিন।
আর উঁচু খেজুর গাছ যাতে আছে খেজুর গুচ্ছ স্তরে স্তরে সাজানো। (রিজকান লিল-ইবাদি) বান্দাহদের রিযিক হিসেবে; আর আমি পানি দিয়ে জীবন্ত করে তুলি মৃত যমিনকে। এভাবেই বের করা হবে। {৫০:১০,১১}
প্রশ্ন হলো- গাছের খেজুর কি শুধু প্রচলিত প্রার্থনাকারীদের (নামায, রোজা পালনকারীর) জন্য?

নিশ্চয়ই না।

এই আয়াতে ‘রিজকান নাস’ বা ‘মানুষের জন্য’ বলা যেত। কিন্তু বলা হয়েছে ‘রিজকান লিল-ইবাদ’।
এসব আয়াত থেকে আবারও বোঝা গেল যে- মুসলিম, ইহুদি, সাবেয়ি, খ্রিষ্টান, অগ্নিপুজক, মুশরিক-সহ সব ধরনের মানুষই আল্লাহর ইবাদ।

পর্যবেক্ষণ ৩:

আল-কিতাবের এই ঘটনাটি আমাদের কাছে সুপরিচিত। অভিশপ্ত শয়তানকে তাড়িয়ে দেওয়ার সময় মহান আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথন।

তিনি বললেন- তুই ওখান থেকে বেরিয়ে যা, কারণ তুই অভিশপ্ত। প্রতিদান দিবস পর্যন্ত বর্ষিত হবে তোর উপর লা’নত।
সে বললো- প্রভু! আমাকে অবকাশ দিন পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত।
তিনি বললেন- যা, তুই তাদের অন্তর্ভুক্ত যাদের অবকাশ দেওয়া হয়েছে। অবধারিত সময়টির (কিয়ামত) আগমন পর্যন্ত।
সে বললো- প্রভু! যেহেতু আপনি আমাকে বিপথগামী করেছেন, সে জন্যে আমি পৃথিবীতে তাদের (মানুষের) জন্যে বিপথগামিতাকে চাকচিক্যময় করে তুলবো এবং তাদের সবাইকে বিপথগামী করে ছাড়বো; শুধুমাত্র তাদের মধ্যে আপনার মুখলেস বান্দাহ ছাড়া। (ইল্লা আবাদাকা মিনহুমুল মুখলিসিন)
আল্লাহ্ বললেন: এটাই আমার কাছে পৌঁছানোর সরল পথ। আমার দাসদের (ইন্না ইবাদি) উপর তোর কোনো কর্তৃত্ব খাটবে না, শুধু বিভ্রান্তরা- যারা তোর অনুসরণ করবে। অবশ্যই তাদের সবার প্রতিশ্রুত স্থান হলো জাহান্নাম। {১৫:৩৪-৪৩}
রব্বুল আলামিন এখানে তাঁর দাস বা ইবাদ–দের সুস্পষ্টভাবে ২টি দলে ভাগ করেছেন। এই ২টি দলই আল্লাহর ইবাদ/বান্দা। তবে, যেসব ইবাদ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে- সেসব ইবাদ জাহান্নামে যাবে।

সার কথা:

বোঝা যাচ্ছে- আবেদ/ইবাদ হলো তারাই যারা আল্লাহকে মান্য করে এবং যারা আল্লাহকে অমান্য করে- উভয় দল। তারা কেউ জান্নাতে থাকবে এবং কেউ জাহান্নামে থাকবে। এই দলে গোটা জিন ও মানবসমাজ এর অন্তর্ভুক্ত।

কুর’আনের এই ব্যাখ্যার আলোকেই শুধুমাত্র ৫১:৫৬ আয়াতের অর্থ সত্য প্রমাণিত হয়।

وَمَا خَلَقْتُ ٱلْجِنَّ وَٱلْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ {৫১:৫৬}

আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য। {৫১:৫৬};

ইবাদ হলো- আল্লাহর বান্দা বা দাস।
ইবাদত হলো- দাসের কাজ করার স্বাধীনতা, ক্ষমতা বা শক্তি।

অদৃশ্য থেকে দৃশ্যমান সবকিছুই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। সব কিছু আল্লাহর নিয়ম অনুযায়ী চলে। শুধুমাত্র মানুষ ও জিন আল্লাহর স্বাধীন দাস বা মুক্ত গোলাম। অন্য কোনও কিছু মুক্ত বা স্বাধীন নয়। এই মুক্ত বা স্বাধীন অবস্থা- জিন ও মানুষকে আল্লাহর সীমারেখার বাইরে নিয়ে যেতে পারে না। আসলে আল্লাহর সীমারেখা কেউ জানে না- ‘সীমারেখার বাহির’ বলতেও কিছু নেই।

মানুষ একই সঙ্গে স্বাধীন দাস ও আল্লাহর খলিফা। এই মর্যাদা জিনের নেই।

وَمَاخَلَقْتُ ٱلْجِنَّ وَٱلْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ ৫১:৫৬

এই দৃষ্টিকোণ থেকে আয়াতটির উপযুক্ত অনুবাদ হতে পারে-

আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুধু স্বাধীন কর্মী হিসেবে।

আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুধু স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য।

প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন হলো— একজন ইবাদের কাজ কি?
সহজ উত্তর— ইবাদত করা।

ইবাদত বা ইবাদা হলো- ‘একটি সুনির্দিষ্ট পথ’ অনুসরণ করা অথবা- ‘সুনির্দিষ্ট পথ’ অনুসরণ না-করা।

এই কথা আল্লাহ রব্বুল আলামিন কুর’আনে উল্লেখ করেছেন। রসুলাল্লাহ তাঁর কওমকে বলছেন:

আল্লাহ্ই আমার রব ও তোমাদের রব, সুতরাং তাঁরই ইবাদত করো– এটাই সিরাতুল মুস্তাকিম পথ। {৩:৫১}

Indeed, Allah is my Lord and your Lord, so worship Him. That is the straight path.

আল্লাহ্ই আমার রব (প্রভু) এবং তোমাদেরও রব, সুতরাং তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করো, এটাই সিরাতুল মুসতাকিম। {৪৩:৬৪}

Indeed, Allah is my Lord and your Lord, so worship Him. This is a straight path. {43-64}

সুতরাং
রবের ইবাদত করাই হলো- বান্দার কাজ। আর এই কাজের পরিণাম কি?

(هَـٰذَا صِرَٰطٌ مُّسْتَقِيمٌ) হাযা সিরাতুল মুস্তাকিম।

আর নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আমার রব ও তোমাদের রব; কাজেই তোমরা তাঁর ইবাদাত কর, এটাই সরল পথ। {১৯:৩৬}

আর আমারই ইবাদত কর, এটাই সরল পথ। {৩৬:৬১}

নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার রব এবং তোমাদেরও রব, অতএব তোমরা তাঁর ইবাদাত কর; এটাই সরল পথ। {৪৩:৬৪}

একাধিকবার বলা হচ্ছে- هَـٰذَا صِرَٰطٌ مُّسْتَقِيمٌ এটাই সিরাতুল মুস্তাকিম।

পাশাপাশি,
আল্লাহ সতর্ক করে বলেছেন- হে বনি আদম! আমি কি তোমাদের নির্দেশ দেইনি, তোমরা শয়তানের ইবাদত করো না, কারণ, সে তোমাদের সুস্পষ্ট দুশমন। আর কেবল আমারই ইবাদত করো, এটাই সিরাতুল মুস্তাকিম। {৩৬:৬০,৬১}

অর্থাৎ,
মহান ‘রবের ইবাদত’ করাই হলো- সিরাতুল মুস্তাকিম বা সরল পথ।

তাদের সবাইকে বিপথগামী করে ছাড়বো; শুধুমাত্র তাদের মধ্যে আপনার মুখলেস বান্দাহ ছাড়া। (ইল্লা আবাদাকা মিনহুমুল মুখলিসিন) আল্লাহ্ বললেন: ‘‘এটাই আমার কাছে পৌঁছানোর সরল সঠিক পথ। {১৫:৪০,৪১}

আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে মুখলিসন-রা জান্নাতে যাবে এবং শয়তানের অনুসারীরা জাহান্নামের অধিবাসী।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসবে- যেহেতু সবাই আবদ/ইবাদ, সেহেতু কী কী কাজ করলে ‘সিরাতুল মুস্তাকিমে’ থাকা যাবে? অথবা, মুখলেসিন-রা কমপক্ষে কী কী কাজ করে সিরাতুল মুস্তাকিমের মানুষ হতে পারবে?

সে উত্তর পাওয়া যায় আন’আমের ১৫১ থেকে ১৫৩ নং আয়াতে।

হে নবী! বলো: ‘এসো, তোমাদের প্রভু তোমাদের জন্যে যা হারাম করেছেন তা তোমাদের তিলাওয়াত করে শুনাই। সেগুলো হলো: ১.তোমরা তাঁর সাথে কোনো কিছুকেই শরিক করবেনা, ২.পিতা- তার প্রতি ইহ্সান করবে,
৩.দারিদ্রের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবেনা, কারণ আমরাই তাদের এবং তোমাদেরও রিযিক দেই, ৪.প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে ফাওয়াহিশার কাছেও যেয়োনা।
৫.আল্লাহ যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন তোমরা তাকে হত্যা করোনা, তবে যথার্থ কারণ ও হক পন্থায় হলে ভিন্ন কথা। আল্লাহ তোমাদের এসব অসিয়ত (নির্দেশ) করছেন যাতে করে তোমরা আকল খাটাও।
৬.এতিমরা বয়োপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত উত্তম পন্থায় ছাড়া তাদের মাল সম্পদের কাছেও যেয়ো না।
৭.পরিমাণ ও ওজন নায্যভাবে পূর্ণ করে দাও।
৮.আমরা কোনো ব্যক্তির উপর তার সাধ্যের বেশি বোঝা চাপাই না।
৯.তোমরা যখন কথা বলবে, নায্য কথা বলবে নিকটজনের বিপক্ষে গেলেও।
১০.আল্লাহকে দেয়া অঙ্গীকার পূর্ণ করো। আল্লাহ এসব অসিয়ত (নির্দেশ) তোমাদের প্রদান করছেন যাতে করে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো। এটাই আমার সিরাতুল মুস্তাকিম।

সুতরাং
তোমরা এরই অনুসরণ করো। তোমরা বিভিন্ন পথের অনুসরণ করো না; করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। আল্লাহ তোমাদের এসব অসিয়ত (নির্দেশ) প্রদান করছেন যাতে করে তোমরা সতর্ক হও।

এখানে সুনির্দিষ্টভাবে বেশ কিছু কাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
১. আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা যাবে না,
২. পিতা-মাতার প্রতি ইহ্সান করতে হবে,
৩. দারিদ্রের ভয়ে সন্তানদের হত্যা করা যাবে না,
৪. প্রকাশ্যে বা গোপনে ফাওয়াহিশার কাছে যাওয়া যাবে না,
৫. আল্লাহ যা হত্যা করা হারাম করেছেন- তা করা যাবে না,
৬. এতিমদের সম্পদ উত্তম পন্থায় ব্যাবস্থাপনা করতে হবে,
৭. নায্যভাবে ওজন ও পরিমাপ করতে হবে,
৮. যখন কথা বলা হবে, তখন নায্য কথাই বলতে হবে,
৯. আল্লাহকে দেওয়া অঙ্গীকার পূর্ণ করতে হবে।

খেয়াল করলেই দেখা যায়- এখানে কিছু ‘হারাম কাজের’ কথা উল্লেখই করাই হয় নি! এমনকি- সালাত, সাওম, হজ, যাকাত- এসব বিধানের কথাও বলা হয় নি। বোঝা যাচ্ছে— সিরাতুল মুস্তাকিমের পরিধি অনেক বড়! কেউ দুর্ঘটনাবশতঃ কোনও নিষিদ্ধ কাজ করে ফেললে অথবা অন্য কোনও নির্ধারিত কাজ/ আমল না করলেও- সে মূলত সিরাতুল মুস্তাকিম থেকে ছিটকে পড়ে না।

সিরাতুল মুস্তাকিমের কাজগুলো দেখুন- এসব কাজ সমাজ-জীবনে সুস্পষ্ট প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে প্রচলিত ইবাদতের পদ্ধতিতে সমাজে কোনো প্রভাব পড়ে কি?
ভেবে দেখুন।

আমাদের আরও মনে রাখতে হবে যে- সিরাতুল মুস্তাকিমের বাইরে যা আছে- তার গুরুত্ব কম, অথবা তা খারাপ কাজ— এমন তুলনা করার মানসিকতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

প্রতিটি বিষয়ই স্বতন্ত্র ও সুস্পষ্ট। আবার বিষয়গুলো একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্তও বটে।

উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় (বাস্তবতা) হলো- আমাদের প্রচলিত প্রার্থনাগুলো মূলত ইবাদত নয়।

তাদেরকে এ ছাড়া অন্য কোন হুকুমই দেয়া হয়নি যে, তারা শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করবে দীনকে একনিষ্ঠ করে; এবং সালাত কায়েম করবে ও পবিত্র হবে; আর এটাই সঠিক দ্বীন। {৯৮:৫}
নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ, আমি ছাড়া কোনও ইলাহ নাই, তাই আমার ইবাদত করো; এবং আমার স্মরণে সালাত কায়েম করো। {২০:১৪}

এখানে ‘ইবাদত’ ও ‘সালাত’ দু’টি সম্পূর্ণ পৃথক জিনিস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইবাদত বা ইবাদা-কে সিরাতুল মুস্তাকিমের সঙ্গে যুক্ত বা শর্ত করা হয়েছে। এর পরিধি তাই ব্যাপক বিস্তৃত। সার্বিক বিষয়াদি এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

উপরোক্ত তিনটি পর্যবেক্ষণ থেকে যা বোঝা গেল:

আমরা বুঝতে পারলাম যে- মানুষের জন্য মানুষ ও জিন ছাড়া অন্য সব সৃষ্টি নির্দিষ্ট পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করে। কিন্তু জিন ও মানুষের জন্য সত্য ও মিথ্যা বা হক ও বাতিল- এই দুটি পথের যে কোনও একটি অনুসরণের যোগ্যতা বা স্বাধীনতা দিয়েছেন মহান আল্লাহ।
এ অবস্থায় মানুষকে দেওয়া “স্বাধীনতার শক্তিকে” ব্যবহার করে সত্যের পথ বা সিরাতুল মুস্তাকিম বেছে নিতে পারে সে। অথবা, অন্য যে কোনও ভুল পথও সে বাছাই করতে পারে। এক্ষেত্রে আল্লাহ কাউকে জোর করেন না। মূলত, তিনিই (আল্লাহ) এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যে কোনও পথ ও মত অনুসরণের অধিকার ও ক্ষমতা মানুষকে দিয়েছেন।
মানুষের জন্য এই “স্বাধীনতার শক্তির” নামই হলো ইবাদত।
যে কেউ আল্লাহর ঘোষিত সিরাতুল মুস্তাকিম থেকে দূরের কোনও পথে চলতে চাইবে- সে তা করতে পারবে। এক্ষেত্রে তাকে আল্লাহর দেওয়া শক্তি, বুদ্ধি, চিন্তাশক্তি, অর্থ, বিত্ত, বৈভব, ক্ষমতা ইত্যাদি ব্যবহার করেই ভুল পথে আগাতে হবে। এসব আল্লাহরই দেওয়া।
আল্লাহর দেওয়া এসব নেয়ামত ব্যবহারের অধিকারের নামই হলো ইবাদত।
অবশ্যই, যে সঠিক পদ্ধতিতে ইবাদত করতে পারবে, সেই হবে চূড়ান্ত সফল। অন্যথায় সে ব্যর্থ হয়ে যাবে এবং শাস্তির যোগ্য প্রমাণিত হবে। আর যে মানুষ জাহান্নামের অধিবাসী- সেও আল্লাহর ইবাদ; এ-কথা ওপরের আয়াতগুলোতে দেখেছি আমরা।
সুস্পষ্ট হলো যে- ইবাদত হলো আল্লাহর পথ অনুসরণ করা বা না-করার স্বাধীনতার শক্তি বা ক্ষমতার নাম; যা স্বয়ং আল্লাহ মানুষ ও জিনকে দিয়েছেন।
যেহেতু, একজন ইবাদ বা বান্দা সত্য ও মিথ্যা- যে কোনও পথই বাছাই করার ‘আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি’ ব্যবহার করতে রতে পারে- সেহেতু এই স্বাধীনতার শক্তির ব্যবহারই হলো ইবাদত।

ইবাদত হলো বান্দাহর স্বাধীনতার অধিকার। এই স্বাধীনতাই হলো মানুষের মহান স্রষ্টা প্রদত্ত মৌলিক অধিকার ও মর্যাদা। যুগে যুগে এই স্বাধীনতার দাবিতেই কোটি কোটি মানুষের প্রাণ ঝরে গেছে। ধ্বংস হয়েছে কত শত দেশ ও সভ্যতা! গড়ে উঠেছে কত নগর- জনপদ। আর মহান আল্লাহ কি তা উপেক্ষা করে গেছেন?
মোটেই না। বরং এই স্বাধীনতার অধিকার মানুষকে বার বার ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি। এটাই মহাগ্রন্থ আল-কিতাবের মূল বক্তব্য! যা মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য! স্রষ্টার ইবাদত করা বা স্রষ্টার দেওয়া স্বাধীনতার শক্তির ব্যবহার করা। শুধুমাত্র এজন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

অথচ, ইবাদতের মূল অর্থ পরিবর্তন করে কিছু সুনির্দিষ্ট কাজকর্মকে ‘ইবাদত’ হিসেবে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। যেই রীতি-পদ্ধতি ও গোলামির জিঞ্জির থেকে মানুষের মেধা ও মননকে মুক্ত করতে যুগে যুগে রব্বুল আলামিনের নবী ও রসুলগণ এসেছিলেন; আল্লাহর নামে ফের সেই বন্ধনেই মানুষকে বেঁধে ফেলেছে কুচক্রী মহল ও অজ্ঞ মানুষ।
মানুষের স্বাধীনতার শক্তি আজ শৃঙ্খলাবদ্ধ।
ইসলামের উদারতা, বিশালতা, গ্রহণযোগ্যতা, ন্যায়বিচার ইত্যাদি নানা রকম মৌলিক সৌন্দর্যকে মুসলিমদের কাছ থেকেই শত-হাজার মাইল দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। মানুষকে স্বাধীন করে দিয়ে তার (নফসের) মেধা ও মনন উন্নত করে সদগুণাবলী বিকাশের যে সুযোগ করে দিয়েছেন আল্লাহ্; তাকে আবার শারীরিক কসরতের রীতি-পদ্ধতিতে আবদ্ধ করে দিয়েছে শয়তান-জিন (ইবলিসের) অনুসারীরা। সেই চক্রান্তই আজ বেশিরভাগ ‘নামধারী মুসলিমের’ ওপর কার্যকর রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *