সুদ কি?
সুদ কি হারাম?
কুরআনের রিবা মানে কি সুদ?
নাকি অন্যকিছু?

মোল্লারা এক কথায় ফতোয়া দেয় যে সুদ খাওয়া হারাম। ব্যাংকে সুদ খাওয়া যাবে না, তাই ইসলামি ব্যাংকের মাধ্যমে ভন্ডামি চালু হয়েছে। বর্তমানে গ্রাহকসংখ্যা এবং আর্থিক লেনদেনে ইসলামি ব্যাংক শীর্ষে।

তাদের তুরুপের তাস একটাই। আর তা হলো রিবা বা প্রচলিত অর্থে সুদ।

কুরআন কি বলে “রিবা” সম্পর্কে? আসেন জেনে নিই।

রিবা শব্দের অর্থ বিভিন্ন আয়াতে করেছে “Increase” বা বৃদ্ধি পাওয়া/Growth/rise

যেমনঃ ১৩ঃ১৭, ৬৯ঃ১০, ২২ঃ৫, ৩০ঃ৩৯, ৪১ঃ৩৯ ইত্যাদি।

৪১ঃ৩৯ “তাঁর এক নিদর্শন এই যে, তুমি ভূমিকে দেখবে অনুর্বর পড়ে আছে। অতঃপর আমি যখন তার উপর বৃষ্টি বর্ষণ করি, তখন সে শস্যশ্যামল ও স্ফীত (রাবাত) হয়। নিশ্চয় যিনি একে জীবিত করেন, তিনি জীবিত করবেন মৃতদেরকেও। নিশ্চয় তিনি সবকিছু করতে সক্ষম।”

এই আয়াতে “রাবা” শব্দের অর্থ “সুদ হয়” বসান তো?
কারো কারো মতে “রিবা” শব্দের আদিমূল (Proto Root) (র-বা) এর অর্থ “শ্বাসরোধ/শ্বাসকষ্ট/Strangulation/Asthma”, “অতিমূল্যায়ন/Overcharging”. এখন, Medical Science এর অগ্রগতির ফলে Bronchial Asthma কে একটু আলাদাভাবে চিহ্নিত করার দরকার হলো। তো সেটিকে বলা হলো, “আর-রাবু”। মূল (Root) “রিবা” অর্থ “শ্বাসরোধ বা শ্বাসকষ্ট” থাকার কারণে এই নতুন শব্দ উৎপন্ন করা হয়েছে “মূল (Root)” এর সাথে সংশ্লিষ্ট থেকে। আরবি ভাষায়, মূল অর্থ থেকে সরে গিয়ে ইচ্ছামত “নতুন শব্দ” গঠন করা যায় না। কারণ আরবী Semitic Language, আর এই Language এর Natural Feature হচ্ছে, এর সমস্ত শব্দ, তার মূল (Root) থেকেই উৎসারিত।

তাহলে কুরআনে ”রিবা” শব্দের ব্যবহার থেকে আমরা দেখতে পাই এর মূল (root) অর্থ হলো শ্বাসরোধ/choke। শ্বাসরোধ হলে কি হয়?
আপনার ফুসফুসে বাতাস প্রবেশ বাধাগ্রস্হ হয়। আপনার হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ রিবা শব্দের অর্থ দুটি হলেও তারা সমার্থক।

১) শ্বাসরোধ/বাধা/choke/obstacles/অতিমূল্যায়ন/Over charging। মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগে/গলা চেপে ধরে অতিরিক্ত মূল্য আদায় হলো রিবা। এটি নেগেটিভ অর্থ।

২) বৃদ্ধি পাওয়া/স্ফিত হওয়া/increase/growth। এটি পজিটিভ অর্থ।

সবই মূলধাতুর সাথে সমার্থক ও সামন্জস্যপূর্ন।

একই আয়াতে আল্লাহ “রিবা” শব্দকে দুইটি অর্থেই (পজিটিভ ও নেগেটিভ) ব্যবহার করেছেন। যেমন

২ঃ২৭৬ “আল্লাহ আল-রাবা (প্রচলিত অনুবাদ সুদ) নিশ্চিহ্ন করেন এবং সাদাকাকে বর্ধিত (ইউরবি, পজিটিভ অর্থ) করেন। আল্লাহ পছন্দ করেন না কোন অবিশ্বাসী পাপীকে”

উক্ত আয়াতে আল-রাবা এর সঠিক অনুবাদ হবে “বাধা/obstacles”। প্রচলিত অনুবাদ অনুসারে আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেননি, সারাবিশ্বের ব্যাংকগুলোতে দেদারসে সুদের লেনদেন হচ্ছে।

কাজেই ২ঃ২৭৬ এ “আল্লাহ বাধাকে নিশ্চিহ্ন/অপসারণ করেন” অনুবাদটাই বেশি যুক্তিযুক্ত।

এবার আসেন দেখি আর কোন্ কোন্ আয়াত রিবাকে “সুদ/usury নাম দিয়ে অর্থবিকৃত করেছে। আয়াতগুলো হলো ২ঃ২৭৫, ২ঃ২৭৮, ৩ঃ১৩০

প্রচলিত অনুবাদঃ

২ঃ২৭৫ “যারা সুদ (আল-রাবা) খায়/consume (ইয়াকুলু) তারা কিয়ামতে দন্ডায়মান হবে, যেভাবে দন্ডায়মান হয় ঐ ব্যক্তি, যাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলে ব্যবসাও(বাইয়ু) তো সুদ (আল-রাবা) নেয়ারই মত! অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে বৈধ করেছেন এবং সুদ (আল-রাবা) হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা তার। তার ব্যাপার আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। আর যারা পুনরায় অপরাধ করে, তারাই দোযখে যাবে। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে।”

তাহলে দেখা যাচ্ছে আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর আল-রাবাকে হারাম করেছেন।

ব্যবসা কি আগে সেটা বুঝতে হবে। ব্যবসায় পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয় সাপ্লাই (যোগান) ও ডিমান্ড (চাহিদা) এর ভিত্তিতে। অর্থাৎ এটি একটি প্রাকৃতিক/স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ায় ন্যায্যমূল্যে পণ্যের ক্রয়বিক্রয়ের মাধ্যমে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েই লাভবান হয়, সন্তুষ্ট হয়, উভয়েরই growth/প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। এটি পজিটিভ রিবা যা সমাজের অর্থনীতিকে স্ফিত করে।

কিন্তু আপনি যদি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কিংবা পণ্য মজুদ করে কৃত্তিম সংকট তৈরি করেন যথেষ্ট যোগান থাকা সত্বেও, তাহলে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ক্রেতার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে, গলা চেপে ধরে যদি অতিরিক্ত মুনাফা আদায় করা হয়, তাহলে সেটা ব্যবসা নয়। সেটাই হলো নেগেটিভ রিবা বা শ্বাসরোধ করা। এতে ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্হ হয়। আল্লাহ এই নেগেটিভ রিবাকে হারাম করেছেন। রমজান মাস আসলেই সুন্নতি দাঁড়িওয়ালা ব্যবসায়ীরা কিভাবে পণ্য মজুদ করে বা সিন্ডিকেট করে পন্যের দাম কৃত্তিমভাবে বাড়িয়েছে তা টিভিতেই দেখতে পেয়েছেন আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের খবরে। সিলেটে বন্যার সময় নৌকার মাঝিরা কিভাবে মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ১০০০ টাকার ভাড়া ৫০ হাজার চেয়েছে সেটাও খবরে এসেছে। এটিই হলো নেগেটিভ রিবা, যা আল্লাহ হারাম করেছেন। ফাইল আটকে রেখে ঘুষ নেয়াটাও নেগেটিভ রিবা, যা হারাম। এই যে ডাক্তার বাবুরা প্রয়োজন না হলেও একগাদা টেস্ট করতে দিয়ে ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন খান, সেটিও নেগেটিভ রিবা। এখানে রুগীর অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছেন আপনারা। যে মুনাফা/সম্পদ উপার্জন মানুষের শ্বাসরোধ করে অর্জন করেন, সেটাই নেগেটিভ রিবা বা হারাম।

২ঃ২৭৫ আয়াতে রিবা অর্থ কোনোভাবেই সুদ নয়। ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে আপনার অর্থ বছরে বৃদ্ধি পায়। এটি পজিটিভ রিবা। এটি ব্যবসা, যা হালাল। কারণ এতে ব্যাংক ও গ্রাহক কারোরই শ্বাসরোধ হচ্ছে না। কোনেপক্ষই কারো অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে না। বরং চুক্তির শর্ত অনুসারে ব্যবসায়িক লেনদেন হচ্ছে।

এখন আপনি যদি ব্যবসা করার জন্য ব্যাংকের কাছে ঋণ নেন ১০% সুদে, সেটি রিবা নয়। সেটি ব্যাংকের সাথে আপনার চুক্তি যা মাসে মাসে কিস্তি আকারে পরিশোধ করার ব্যাপারে আপনি চুক্তিবদ্ধ। ব্যাংকের কর্মাচারিদের বেতন হয় এই মুনাফা থেকে। আপনি ব্যবসা করে সফল হলেন আবার ব্যাংকেরও লাভ হলো। উভয়েই লাভবান হলেন। এটি পজিটিভ রিবা/Growth/অর্থনীতি স্ফিত হওয়া/সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়া।

এখন আপনি যদি চুক্তি অনুসারে ঠিকমত মাসিক কিস্তি দিতে না পারেন, তাহলে ব্যাংক আপনাকে সময় দেয় কিস্তি পরিশোধের। ২ঃ২৮০ তে ঋণগ্রহিতার জন্য কিস্তি পরিশোধের সময় বৃদ্ধির কথা বলছেন আল্লাহ। সেই সময় অতিবাহিত হলে সুদটা চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়তে থাকে। এটিও হারাম নয় যদি এসব শর্তগুলো চুক্তিপত্রে লেখা থাকে যে ডিফল্টার হলে কি হারে সুদ বাড়বে। অর্থাৎ চুক্তি অনুসারে যে সুদ বৃদ্ধি পায়, সেটি নেগেটিভ রিবা বা হারাম নয়। অর্থাৎ সকল তথ্য জেনেই আপনি ব্যবসায়িক ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংক থেকে এই ঋণ নিয়েছেন। তবে কেউ যদি কোনো মুমিনের কাছ থেকে ঋণ নেয় এবং সে ব্যবসায় লস খেয়ে অসহায় অবস্থায় পড়ে, তাহলে ঋণদাতা মুমিনের উচিত সেটিকে সাদাকা করা। এই উপদেশও দিচ্ছেন আল্লাহ ২ঃ১৮০ তে।
সেকারণেই ২ঃ২৮২ তে ঋণ সংক্রান্ত চুক্তি লিপিবদ্ধ/উকতুব বা কিতাব আকারে সংকলিত করতে বলেছেন আল্লাহ। এই চু্ক্তিপত্র/কিতাব এর বাইরে ব্যাংক যদি চক্রবৃদ্ধি হারে তাদের ইচ্ছামত সুদের হার বৃদ্ধি করে, তাহলে সেটা হবে নেগেটিভ রিবা, কারণ এতে ঋণগ্রহিতার অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে ব্যাংক। ২ঃ২৭৫-২ঃ২৮৩ আয়াতগুলোতে ব্যবসা, নেগেটিভ রিবা, ঋণ, কিস্তি পরিশোধের সময়বৃদ্ধি, ঋণচুক্তি ইত্যাদি বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন আল্লাহ।

৩ঃ১৩০ সঠিক অনুবাদ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা দূর্বল/ অসহায়দের (জয়িফ) কাছ থেকে সীমাহীনভাবে (মুজা’ফাতা) আল-রাবা খেয়ো (তাকুলু/consume) না। আর আল্লাহর সাথে সংযোগ স্থাপন (ইত্তাকু) করতে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণ অর্জন করতে পারো।”

প্রচলিত অনুবাদে জয়িফ শব্দটার অর্থ করছে “চক্রবৃ্দ্ধি হারে সুদ” – যা পুরাই ভুয়া অনুবাদ। “জয়িফ হাদিস” মানে দূর্বল হাদিস অনুবাদ করে মোল্লারা। এই জয়িফ শব্দটা আরো আয়াত আছে ৩ঃ১৪৬, ২ঃ২৬৬, ৪ঃ২৮, ৪ঃ৭৬ ইত্যাদি। সবখানেই জয়িফ মানে দূর্বল/অসহায়, কিছু আয়াতে প্রসংগ অনুসারে এর অর্থ হলো অসীম/সীমাহীন/লাগামহীন।

যেমন ৫৭ঃ১১

“কে সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর বিধানকে উত্তম (হাসানা) সঠিক ভাবে পালন (ক্বর্য) করবে, এরপর তিনি তার জন্যে তা বহুগুণে/সীমাহীনভাবে (জায়িফাহু) বৃদ্ধি করবেন এবং তার জন্যে রয়েছে সম্মানিত পুরস্কার।”

অর্থাৎ ৩ঃ১৩০ এ দূর্বল/অসহায়দের কাছ থেকে সাধ্যের সীমা ছাড়ানো/লাগামহীনভাবে আল-রাবা (নেগেটিভ রিবা) গ্রহণ না করতে উপদেশ দেয়া হচ্ছে মুমিনদের, যে কাজটা আমাদের ব্যবসায়ীরা রমজান মাস আসলেই করে থাকে। পন্যের দাম বৃ্দ্ধির কারণে গরীবরা খাবার কিনতে পারেনা।

এই ৩ঃ১৩০ আয়াতে জয়িফ শব্দটারে “চক্রবৃদ্ধি সুদের হার” অনুবাদ করে মোল্লারা/পার্সিয়ানরা ঘোল খাওয়াইতেছে সবাইকে।

সামারিঃ

আল-রাবা/রিবা কোনো সুদের হার নয়।

পজিটিভ রিবা হলো growth/প্রবৃদ্ধি/স্ফিত হওয়া, যা ব্যবসার কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়, যা আল্লাহ হালাল করেছেন।

নেগেটিভ রিবা হলো জয়িফ (দূর্বল/অসহায়) দের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কৃত্তিম সংকট তৈরি করে স্বাভাবিক ব্যবসার নীতি বিসর্জন দিয়ে, শ্বাসরোধ/গলা চেপে ধরে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করা। আল্লাহ এটাই হারাম করেছেন।

ব্যাংকের সুদের হার/ঋণপত্র/চুক্তিপত্রের সাথে রিবার কোনো সম্পর্কই নেই। শুধুমাত্র চু্ক্তি ভঙ্গ করে অসহায়দের ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণে অসহায়ত্বের সুযোগে সুদের হার বাড়ালে সেটা হবে নেগেটিভ রিবা, যা হারাম।

সুতরাং নিশ্চিন্তে সঞ্চয়পত্র কিনেন, ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহযোগিতা করেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে সম্পদ বৃদ্ধি করেন, এবং সেখান থেকে অসহায়/পিছিয়ে পড়া জনতার জন্য সাদাকা করেন।

আর মোল্লার ফতোয়ার উপর ভরসা করে হালালকে হারাম মনে করে জীবন পার করলে সেটা হয়ে যাবে শিরক। কারণ কুরআনে আল্লাহ যা হালাল করেছেন (পজিটিভ রিবা/প্রবৃদ্ধি/ব্যবসা), মোল্লা সেটা সুদ নাম দিয়ে করে দিয়েছে হারাম। আর আল্লাহ যা হারাম করেছেন (নেগেটিভ রিবা/শ্বাসরোধ/choke/অসহায়ত্বের সুযোগে কৃত্তিম সংকট তৈরি করে অতিরিক্ত মুনাফা আদায়), সেটা নিয়ে মোল্লার বা কারো কোনো মাথাব্যথা নাই, কারণ মোল্লাদের ওয়াজের হাদিয়া/লিল্লার একটা বড় অংশ আসে এই অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে।
আবু মজুমদার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *