ইতিকাফ একটি সুপরিচিত নাম। ইতেকাফ সম্পর্কিত কোন আয়াতে নেই এবং এটা বাংলা শব্দ নয়। কাজেই ইতেকাফ কথাটার আভিধানিক অর্থ না খুজে কুরআনে ব্যবহৃত সরাসরি আকিফুন কথাটা নিয়েই আলোচনা প্রয়োজন। প্রায় সকল বাংলা অনুবাদেই নিচের আয়াতে উল্লেখিত আকিফুন ( عكفون) কথাটির অনুবাদ ইতেকাফ করা হয়েছে যাহা অবশ্যই ভুল অনুবাদ। আয়াতটি দেখুনঃ
اُحِلَّ لَکُمۡ لَیۡلَۃَ الصِّیَامِ الرَّفَثُ اِلٰی نِسَآئِکُمۡ ؕ ہُنَّ لِبَاسٌ لَّکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ لِبَاسٌ لَّہُنَّ ؕ عَلِمَ اللّٰہُ اَنَّکُمۡ کُنۡتُمۡ تَخۡتَانُوۡنَ اَنۡفُسَکُمۡ فَتَابَ عَلَیۡکُمۡ وَ عَفَا عَنۡکُمۡ ۚ فَالۡـٰٔنَ بَاشِرُوۡہُنَّ وَ ابۡتَغُوۡا مَا کَتَبَ اللّٰہُ لَکُمۡ ۪ وَ کُلُوۡا وَ اشۡرَبُوۡا حَتّٰی یَتَبَیَّنَ لَکُمُ الۡخَیۡطُ الۡاَبۡیَضُ مِنَ الۡخَیۡطِ الۡاَسۡوَدِ مِنَ الۡفَجۡرِ۪ ثُمَّ اَتِمُّوا الصِّیَامَ اِلَی الَّیۡلِ ۚ وَ لَا تُبَاشِرُوۡہُنَّ وَ اَنۡتُمۡ عٰکِفُوۡنَ ۙ فِی الۡمَسٰجِدِ ؕ تِلۡکَ حُدُوۡدُ اللّٰہِ فَلَا تَقۡرَبُوۡہَا ؕ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰہُ اٰیٰتِہٖ لِلنَّاسِ لَعَلَّہُمۡ یَتَّقُوۡنَ ﴿۱۸۷﴾
রাতের সিয়ামে আপন স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা করা তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে, তারা তোমাদের জন্য এবং তোমরা তাদের জন্য পরিপূরক , তোমরা যে নিজেদের ক্ষতি করছিলে আল্লাহ তা জ্ঞাত আছেন, এ জন্য তিনি তোমাদের প্রতি প্রত্যাবৃত্ত হলেন এবং তোমাদের (ভার) লাঘব করে দিলেন; অতএব এক্ষণে তোমরা ( রাতের সিয়ামেও) তাদের সাথে মিলিত হও এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিপিবদ্ধ করেছেন তা অনুসন্ধান কর এবং প্রত্যুষে কালো সূতা /জুলুমাত হতে সাদা সূতা /নূর প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত তোমরা আহার/ কুরআন গ্রহন করে ও পান কর/ নিজেকে শীতল করে, অতঃপর লাইল পর্যন্ত তোমরা সিয়াম পূর্ণ কর; তোমরা মাসজিদে ই‘তিকাফ করার সময় মিলিত হবেনা; এটিই আল্লাহর সীমা। অতএব তোমরা উহার নিকটেও যাবেনা; এভাবে আল্লাহ মানব মন্ডলীর জন্য তাঁর নিদর্শন সমূহ বিবৃত করেন, যেন তারা সংযত হয়।
(২ঃ১৮৭) এখন আকিফুন কথাটার অনুবাদ অন্যান্য আয়াতে কি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা পবিত্র কুরআন থেকে দেখিঃ
১। সুরা আরাফঃ
আমি বানী ইসরাঈলকে সমুদ্র পার করিয়ে দিলাম, অতঃপর তারা মূর্তি পূজারত এক জাতির সংস্পর্শে এল। তারা বললঃ হে মূসা! তাদের যেরূপ মা‘বূদ রয়েছে, আমাদের জন্যও ঐরূপ মা‘বূদ বানিয়ে দাও। সে বললঃ তোমরা একটি মূর্খ সম্প্রদায়।(৭ঃ১৩৮) এখানে শব্দটি (يعكفون) ক্রিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং অনুবাদ করা হয়েছে প্রতিমা ‘পুজারত’ ছিল। এখানে পুজারত মানে নিষ্ঠার সাথে কিছু করাকেই বুঝায়।
২। সুরা ‘ত্ব – হা’
তারা বললো, আমরা এর উপরই অবিচল নিষ্ঠার সাথে /(পুজারত) লেগে থাকব যতক্ষণ পর্যন্ত মুসা আমাদের কাছে ফিরে না আসে।(২০ঃ৯১) এখানে عكفين শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে যার অনুবাদ অবিচল থাকা বা নিষ্ঠার সাথে লেগে থাকা বুজায়।
৩। সুরা -ত্ব-হাঃ
সুরা ত্ব-হা “তুমি তোমার সেই মাবুদের প্রতি লক্ষ্য কর যার পুজায় তুমি নিষ্ঠাবান ছিলে আমরা ওকে জ্বালিয়ে দিবই, অতঃপর ওকে বিক্ষিপ্ত করে সাগরে নিক্ষেপ করবোই”।(২০ঃ৯৭)
এই আয়াতে عاكفا দ্বারা নিষ্ঠাবান রত ছিলে বা পুজায় নিষ্ঠাবান ছিলে বুঝানো হয়েছে।
সুরা আশ শোয়ারাঃ
“তারা বলল আমরা মূর্তি পুজা করি এবং আমরা নিষ্ঠার সাথে তাদের সাধনা রত থাকবো।(২৬ঃ৭১) এই আয়াতে عكفين (আকিফিন) শব্দ দ্বারা নিষ্ঠার সাথে সাধনা করা বুঝানো হয়েছে।
এভাবে ২১ঃ৫২, ৪৮ঃ২৫, ২২ঃ২৫ আয়াত গুলোতেও আকিফুন عكفون শব্দটি দেখতে পাই। সব মিলিয়ে এর অর্থ:
১. নিষ্ঠাবান
২. নিষ্ঠায় রত
৩.পুজায়রত
৪.মনোনিবেশ করে কাজ করা বুঝানো হয়েছে।
এখন আমরা উপরের আয়াতগুলো থেকে আকিফুনের অর্থ যা প্রকাশিত হল তা হল –
যে কোন আল্লাহ অনুমোদিত কাজ নিষ্ঠার সাথে করাই হল আকিফুন যাহা ২ঃ১৮৭ আয়াতে ইতেকাফ বলা হয়েছে।
মসজিদ ঃ
মসজিদ مسجد বিশেষ্যপদ হিসেবে কুরআনে ২৫ বারেরও বেশি এসেছে। এর ক্রিয়াপদ সাজদা কথাটাও ২৩ বারের অধিক এসেছে। সব মিলিয়ে শব্দটা প্রায় ৫৮ বার আছে।
এর ত্রিমাত্রিক মূল tri literal root س ج د “ছিন, জিম, দাল” কুরআনের আয়াত গুলো পড়া হলে এর প্রকৃত অর্থ বেরিয়ে আসবে। সাধারণ অর্থে সেজদার স্থান হলো মসজিদ। আর সেজদা অর্থ ঃ
১.অনুগত হওয়া
২.মেনে নেওয়া বুঝায়।
কাজেই মাসাজিদের অর্থ দাঁড়ায় আনুগত্যের স্থান, মেনে নেওয়ার স্থান, সে হিসেবে পুরো পৃথিবীতে যেখানে সেজদা তথা মেনে নেওয়া(কুরআন) অনুগত্য করা সম্ভব সেটাই মসজিদ। মুসাকে বলা হয়েছে তাদের অবস্থা গুলো যেন কিবলা মূখী /ঈমানের দিক নির্দিষ্ট করে মুসলিম হিসেবে অবস্থা তৈরি করা হয়। আমাদের ঘরের যে স্থানটিতে সেজদা তথা সালাত আদায় হয় তাও মসজিদ। আবার আমাদের কর্মশালা যেখানে আনুগত্যের সাথে কাজ করা হয় তাও মসজিদ।
মাসাজিদে আকিফুন করার অর্থ দাড়াল নিষ্ঠার সাথে কর্মশালায় কাজ সম্পাদন করা।
আমার অফিসে আমি যদি আনুগত্যের সাথে অথবা নিষ্ঠার সাথে কাজ করি তাই হল আকিফুন। একজন শিক্ষক নিষ্ঠার সাথে পাঠদান করেন অথবা একজন ছাত্র নিষ্ঠার সাথে পড়াশুনা করে তাহলে সেটাই আকিফুন বা ইতেকাফ।
বলা হয়েছে আকিফুন করার সময় কোন রকম সংযোগ বা যোগাযোগ করা থেকে বিরত থাকতে।
ولا تباشرهن
বেশিরভাগ অনুবাদক এর অনুবাদ করেছে, ইতিকাফরত অবস্থায়ন সহবাস থেকে দূরে থাকার জন্য। সহবাসের বিষয়টি আয়াতের প্রথমে الرفث রাফাস শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ এখানে
تبشروهن
তুবাসশিরুহুন্না এর অনুবাদ করেছে সহবাস করা।
অথচ এর সঠিক অনুবাদ হবে have relations with them.
১.তাদের সংযোগ স্থাপন করা অথবা
২.সুসংবাদ বিনিময় করা ইত্যাদি।
একটু লক্ষ করুন মসজিদে কেউ স্ত্রী নিয়ে প্রচলিত ইতেকাফ করে না কাজেই স্ত্রী গমনের প্রশ্নই আসে না। কাজেই কথাটা এই আয়াতের সাথে অসামঞ্জস্য।
এভাবেই ভ্রান্তির বেরাজালে বিকৃত বিধান দিয়ে পালন করা হচ্ছে আকিফুন তথা ইতেকাফ।
তাই প্রচলিত ইতিতাফের সাথে কুরআনের আকিফুনের কোন মিল নেই।