পর্ব ০১
বর্তমান কালে অনেক ক্ষেত্রে মনে হয়, ইহুদীদের সাথে মুসলমানদের প্রচন্ড বৈরী সম্পর্ক, শত্রু ভাবাপন্ন। অনেকেই দাবী করেন, ইহুদীদের প্রতি মুসলমানদের এই বিদ্বেষ কোরআন থেকে শিক্ষা প্রাপ্ত। কোরআন কি আসলেই তাই শিক্ষা দেয়? কোরআনে কি আসলেই ইহুদীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা apes and swine, যা অনেকেই দাবী করেন?
এক কথায় উত্তর, ‘না’। কোরআনের কোথাও ইহুদীদের apes and swine বলা হয় নি বা তাদেরকে ঘৃনা করতে বলা হয় নি। এই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমরা দেখবো, পুরো কোরআনে ইহুদীদের সম্পর্কে কি বলা আছে?
পুরো কোরআনে প্রায় ৬০ টির মতো আয়াত আছে যেখানে ইহুদীদের প্রতি বা ইহুদীদেরকে নিয়ে বলা হয়েছে। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ আয়াতে শুরু করা হয়েছে, ‘হে বনী ইসরাইল’ শব্দ দিয়ে, বাকী গুলোতে বলা হয়েছে, ‘ইহুদী’ (yahud) বা ‘তারা, যারা ইহুদী’ (alladhina hadu)- এই ভাবে। এছাড়া আরো কিছু জায়গায় ইহুদীদের এবং খ্রিস্টানদেরকে একসাথে বোঝানোর জন্য বলা হয়েছে, ‘কিতাবপ্রাপ্ত জাতি’ (ahl al-kitab) এবং ‘তারা, যারা কিতাবপ্রাপ্ত হয়েছে’ (alladhina utu al-kitab)। এছাড়াও কোরআনো এক ডজনেরও বেশি বার ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ ‘তৌরাত’-এর নাম এসেছে, এসেছে তাদের নবী দাউদ (আঃ) এবং মুসা (আঃ)-এর নাম। এ সমস্ত আয়াত ছাড়াও কোরানের ১৭ নম্বর সুরাটি সম্পূর্ণ ইহুদীদের নিয়েই, যার নাম ‘সুরা বনী ইসরাইল’।
কোরআনে ইহুদীদের সম্পর্কে কি বলা হয়েছে, তা ভালোভাবে বোঝার জন্য আমরা আগে জানতে চাই দ্বীন নিয়ে কোরআনে কি বলা হয়েছে। কোরআন অনুযায়ী সঠিক দ্বীন হচ্ছে ‘আল্লাহর কাছে আনুগত্য প্রকাশ করা’ (Submission to God)। এরাবিক ‘الإسلام’ শব্দটির আভিধানিক অর্থও হচ্ছে Submission surrender to God. এই অর্থে যারা আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল তারা সবাই মুসলিম। এভাবে কোরআন অনুযায়ীই ইসলাম হচ্ছে এমন একটি দ্বীন যে দ্বীনের অনুসারী আদম থেকে নুহ, নুহ থেকে ইব্রাহীম, ইব্রাহীম থেকে মুসা,ইসা, আহমাদ সবাই (10:71-72, 84; 2:128-131; 5:110-111)। এভাবেই পার্থক্য করা সম্ভব কোরআনে ব্যবহৃত ‘মুসলিম’ শব্দ, যেটা as a generic name, অর্থাৎ যারা ‘আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল’, তাদের সাথে, যারা ‘মুসলিম’, যেটা as a proper noun, অর্থাৎ যারা আহমদের অনুগামী, যে দ্বীন ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে চলে আসছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি কাউকে ‘মুসলিম’ (generic name) হবার জন্য ‘মুসলিম’ (proper noun) হতে হবে? একজন ইহুদী, যে আহমদকে একজন নবী বলে এবং কোরআনকে আল্লাহর বানী বলে তার কি ইসলামে convert হওয়ার প্রয়োজন আছে? কোরানের আলোকে এর উত্তরটি খুবই চমকপ্রদ এবং সেটা হচ্ছে ‘না’।
কোরআন অনুযায়ী আহমদের পূর্বের সকল নবীই ‘মুসলিম’ এবং তারা, যারা সেইসব নবীদের বিশ্বাস করেছেন এবং অনুগামী হয়েছেন। বরঞ্চ ইহুদীরা কোরআনে বিশেষভাবে সম্মানিত হয়েছে এইভাবে—
“O children of Israel, remember my favor which I bestowed upon you, and that I favored you above all creation.” (Qur’an 2:47, 2:122).
হে ইস্রাঈল-সন্তানগণ! আমার সেই অনুগ্রহকে স্মরণ কর, যা দিয়ে আমি তোমাদেরকে অনুগৃহীত করেছি এবং (তৎকালে) বিশ্বে সকলের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। ২ঃ১২২ এবং ২ঃ ৪৭
কোরআনে ইহুদীদের এই বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তির ব্যাপারে এবং তাদের সাথে অঙ্গীকারের ব্যাপারে আরো বলা হয়েছে,
O children of Israel, indeed we delivered you from your enemy and made a covenant with you on the right side of the mountain, and we sent down for you manna and quails. (20:80)
হে বানী ইস্রাঈল! নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে তোমাদের শত্রু হতে উদ্ধার করলাম, আমি তোমাদেরকে ত্বুর পাহাড়ের ডান পাশে (তাওরাত) দানের প্রতিশ্রুতি দিলাম এবং তোমাদের নিকট ‘মান্ন্’ ও ‘সালওয়া’ প্রেরণ করলাম।
Indeed we gave the children of Israel the Book, and wisdom, and the prophecy, and we provided them with good things and favored them above all creation. (45:16)
আমি তো বনী-ইস্রাঈলকে গ্রন্থ, কর্তৃত্ব ও নবুঅত দান করেছিলাম এবং ওদেরকে উত্তম জীবিকা দিয়েছিলাম এবং বিশ্বজগতের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম।
We made a covenant with the children of Israel: “Serve none except God. Be good to parents, relatives, orphans, and the poor. Speak kindly to people. Establish prayer and give alms.” Afterward, you turned away, except a few of you, and you were averse. (2:83)
আর স্মরণ কর, যখন আমরা ইসরাঈল-সন্তানদের প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো ‘ইবাদাত করবে না, মাতা-পিতা [১], আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও দরিদ্রের [২] সাথে সদয় ব্যবহার করবে এবং মানুষের সাথে সদালাপ করবে [৩]। আর সালাত প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত দিবে, তারপর তোমাদের মধ্য হতে কিছুসংখ্যক লোক ছাড়া [৪] তোমরা সকলেই অবজ্ঞা করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলে।
কোরআন এখানে ইহুদীদের বিশেষ সম্মান এবং অঙ্গীকারের কথা বলেছে, ইহুদীদেরকে সমালোচনামূলক কথা কোন জায়গায় আছে? শেষ আয়াতের (2:83) শেষের দিকে বলা হয়েছে, ‘Afterward, you turned away, except a few of you, and you were averse.’—সেটা হচ্ছে এই বিশেষ সম্মান এবং অঙ্গীকার দেওয়া সত্বেও যারা সেটাকে ভঙ্গ করে তাদের ব্যাপারে। এই প্রসঙ্গে সুরা বাকারাতে আরো আছে—
Moses came to you with clear proofs, yet you took the calf [for worship] in his absence, and you turned wicked. (Qur’an 2:92)
অবশ্যই মূসা তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ [১] এসেছিলেন, তারপর তোমরা তার অনুপস্থিতিতে গো বৎস কে (উপাস্যরুপে) গ্রহন করেছিলে। বাস্তবিকই তোমরা যালিম [২]।
We made a covenant with you, that you not shed each others’ blood, nor evict each other from your homes. You agreed and bore witness. Yet it is you who are killing each other and evicting a group among you from their homes, supporting each other against them unlawfully and aggressively; and if they should come to you as captives you would ransom them—while evicting them was unlawful for you. Do you then believe in a part of the Book and disbelieve in the other? (Qur’an 2:84-85)
আর স্মরণ কর, যখন তোমাদের প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম, ‘তোমরা একে অপরের রক্তপাত করবে না এবং একে অন্যকে স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করবে না, তারপর তোমরা তা স্বীকার করেছিলে। আর তোমরা তার সাক্ষ্য দিচ্ছ।
তারপর তোমরাই তারা, যারা নিজেদের কে হত্যা/অপমানিত করছো এবং তোমাদের এক দলকে তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করছ। তোমরা একে অন্যের সহযোগীতা করছ তাদের উপর অন্যায় ও সীমালঙ্ঘন দ্বারা। আর তারা যখন বন্দীরুপে তোমাদের কাছে উপস্থিত হয় তখন তোমরা মুক্তিপণ দাও [১] ; অথচ তাদের কে বহিষ্কার করাই তোমাদের উপর হারাম ছিলো। তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে ঈমান আনো এবং কিছু অংশে কুফরী করো ? তাহলে তোমাদের যারা এরুপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ও অপমান এবং কেয়ামতের দিন তাদের কে ফিরিয়ে নেয়া হবে কঠিনতম শাস্তির দিকে। আর তারা যা করে আল্লাহ্ সে সম্পর্কে গাফিল নন।
You have known those among you who violated the Sabbath, so we said to them: “Be despicable ape.” (Qur’an 2:65)
আর তোমাদের মধ্যে যারা শনিবার সম্পর্কে সীমালঙ্ঘন করেছিলো তাদের কে তোমরা নিশ্চিতভাবে জেনেছিলে [১]। ফলে আমরা তদেরকে বলেছিলাম, ‘তোমরা ঘৃণিত বানরে পরিণত হও’।
দেখুন, শেষ আয়াতটিতে কিন্তু বলা হয়েছে, যারা ‘সাব্বাথ’ ভঙ্গ করে তারা ‘despicable ape’, অর্থাৎ এটা কিন্তু ইহুদীদেরকে বলে নি, বলা হয়েছে তাদেরকে, যারা তাদের ধর্মীয় আচরন পালন করেনি (সাব্বাথ- ইহুদীদের একটি ধর্মীয় আচরণ)।
কোরানের আরেক জায়গায় কিন্তু ‘Apes and swine’ কথাটা এসেছে, কিন্তু সেটা ইহুদীদের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়-
Shall I inform you of something worse in the sight of God: those whom God has cursed and with whom he is angry, and he has made some of them apes and swine and servants of evil. These are in a worse position and more astray from the even path. (5:60)
বলুন, ‘আমি কি তোমাদেরকে এর চেয়ে নিকৃষ্ট পরিণামের সংবাদ দেব যা আল্লাহর কাছে আছে? যাকে আল্লাহ লা’নত করেছেন এবং যার উপর তিনি ক্রোধান্বিত হয়েছেন। আর যাদের কাউকে তিনি বানর ও কাউকে শূকর করেছেন [১] এবং (তাদের কেউ) তাগূতের ইবাদাত করেছে। তারাই অবস্থানের দিক থেকে নিকৃষ্ট এবং সরল পথ থেকে সবচেয়ে বেশি বিচ্যুত’।
এই আয়াতটা কিন্তু সামগ্রিকভাবে সবার জন্যই বলা হয়েছে, কিন্তু অনেকে বলে থাকেন এখানে ইহুদীদেরকে নিয়ে বলা হয়েছে। এর আগের দুটো আয়াত লক্ষ্য করুন,
O you who believe, do not befriend those who make a mockery of your religion from among those who were given the Book before you or the disbelievers. Reverence God, if you are truly believers. When you call to prayer they make a mockery and a game of it. This is because they are a people who do not understand. (5:57-58)
হে মুমিনগণ! তোমাদের আগে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে যারা তোমাদের দ্বীণকে হাসি-তামাশা ও খেলার বস্তুরূপে গ্রহণ করে তাদেরকে ও কাফেরদেরকে তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না এবং তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক [১]।
আর যখন তোমরা সালাতের প্রতি আহবান কর তখন তারা সেটাকে হাসি-তামাশা ও খেলার বস্তুরূপে গ্রহণ করে –এটা এ জন্য যে, তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা বোঝে না।
লক্ষ্য করুন, বলা হয়েছে, যারা আহলে কিতাবধারী (ইহুদী এবং খ্রিস্টান), এবং যারা অবিশ্বাসী, তারা যদি আহমদের দ্বীন(যা islam, as a generic name) নিয়ে mockery (উপহাস) করে, তাহলে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করো না। এই আয়াতে আহলে কিতাবধারী হিসেবে ইহুদীদেরও বোঝানো হয়েছে, কিন্তু কোনো মতেই 5:60- এ ইহুদীদের উদ্দেশ্য করা বলা হয় নি। আমি আগেই বলেছি, কোরআনে ইহুদীদের নিয়ে আয়াত গুলোতে তাদের কি কি নামে সম্বোধন করা হয়েছে। তাই 5:60 আয়াতে উল্লিখিত apes and swine অবশ্যই ইহুদীদেরকে নিয়ে নয়, বরং যাদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ নাযিল হয়েছে, তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা (আর যারা আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল নয়, তাদের প্রতিই অভিশাপ নাজিল হয়েছে)। এখানে অবশ্যই বলার অপেক্ষা রাখেনা, শুধুমাত্র ‘মুসলিম’ রাই (proper noun) আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল নয়, বরং প্রকৃত ধর্মপ্রাণ ইহুদী এবং খ্রিস্টানরাও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল। এরূপ প্রকৃত ধর্মপ্রাণ ইহুদী এবং খ্রিস্টানদের, যারা আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল, তাদের উদ্দেশ্যে কোরআনে আছে–
They are not all alike; among the people of the Book there is an upstanding community. They recite God’s revelations through the night, and they fall prostrate. They believe in God and the last day. They advocate good and forbid evil, and they hasten to do good works. These are among the righteous. Whatever good they do will not be denied. God knows those who are reverent. (Qur’an 3:113-115)
তারা সবাই একরকম নয়। কিতাবীদের মধ্যে অবিচলিত এক দল আছে; তারা রাতে আল্লাহ্র আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করে এবং তারা সিজ্দা করে [১]।
তারা আল্লাহ এবং শেষ দিনে ঈমান আনে, সৎকাজের নির্দেশ দেয়, অসৎকাজে নিষেধ করে এবং তারা কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতা করে [১]। আর তারাই পূণ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত।
Surely those who believe, those who are Jews, the Sabians, and the Christians, whoever believes in God and the last day and does good, has nothing to fear nor will they grieve. (Qur’an 5:69)
নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং যারা ইয়াহুদী হয়েছে, আর সাবেয়ী [১] ও নাসারাগণের মধ্যে যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের উপর ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না [২]।
অর্থাৎ, তারাও ভালো কাজের ফলাফল পাবে (যদিও তারা ‘মুসলিম’- as proper noun, নয়)।
এমনকি কোরআনে ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে বলা হয়েছে, কোরআন অবিকৃত তৌরাতের (লক্ষ্য করুন, বিকৃত তৌরাত নয় কিন্তু) সম্পূরক। বরঞ্চ কোরআনে ইহুদীদেরকে ক্রিটিসাইজ করে একটা আয়াত আছে, এটা নাযিল হয়েছিলো, যখন সেখানকার ইহুদীরা তৌরাত থাকা সত্বেও আহমদের কাছে বিচারের জন্য আসে-
How do they make you a judge while they have the Torah in which is God’s law? Then they turn back after that—these are not believers. (Qur’an 5:43)
আর তারা আপনার উপর কিভাবে বিচার ভার ন্যস্ত করবে অথচ তাদের কাছে রয়েছে তাওরাত যাতে রয়েছে আল্লাহর বিধান? তা সত্ত্বেও তারা এরপর মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তারা মুমিন নয়।
লক্ষ্য করুন, এখানে কিন্তু তৌরাতের গুরুত্বই বর্ননা করা হয়েছে। এর পরের আয়াতেই আরো পরিস্কার ভাবে বলা হয়েছে—
We sent down the Torah, in which there is guidance and light, by which the prophets who submitted judged the Jews, as did the rabbis and the priests, according to what they were required to observe of God’s Book, and thereunto were they witnesses. So do not fear people, but fear me, and do not sell my signs for minor gain. Whoever does not judge by what God has sent down are disbelievers. (5:44)
নিশ্চয় আমরা তাওরাত নাযিল করেছিলাম; এতে ছিল হেদায়াত ও আলো; নবীগণ, যারা ছিলেন অনুগত, তারা ইয়াহুদীদেরকে তদনুসারে হুকুম দিতেন [১]। আর রব্বানী ও বিদ্বানগণও (তদনুসারে হুকুম দিতেন), কারণ তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের রক্ষক করা হয়েছিল। আর তারা ছিল এর উপর সাক্ষী [২]। কাজেই তোমরা মানুষকে ভয় করো না এবং আমাকেই ভয় কর। আর আমরা আয়াত সমূহের বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য ক্রয় করো না। আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই কাফের [৩]।
এই সমস্ত আয়াত দ্বারাই বোঝা যাচ্ছে, যারা প্রকৃত ধর্মপ্রাণ ইহুদী এবং খ্রিস্টান, তাদের সম্পর্কে কোরআনে কোনো রূপ সমালোচনামূলক কোনো কথা বলা হয়নি। কোনো আয়াতে ইহুদী বা খ্রিস্টানদের ঘৃনা করতেও বলা হয় নি।
অনেকে কোরআনের কিছু আয়াতের কথা বলে, সেখানে হয় তারা ইচ্ছাকৃতভাবে আগের আয়াত বা পরের আয়াত বাদ দেয়, নতুবা তরজমার সময় কোনো শব্দ উহ্য রাখে। আরবি এমন একটি ভাষা যে ভাষায় একই শব্দের উচ্চারনের তারতম্যের জন্য পুরো বিপরীত অর্থ প্রকাশ করে, এমনকি অনেক শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থবোধক একাধিক অর্থ হয়। কোরান তরজমা করার সময় অনেকেই এই ভাষাগত সুযোগ গ্রহন করে বিভ্রান্তির চেষ্টা করে, যা কোনোভাবেই উচিত নয়।
কোরআনে যদি ইহুদী বা খ্রীস্টানদের নিয়ে বলা হতো যে, তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখো না, {অনেকেই নিচের আয়াতগুলোর উদাহরণ দেন—
O you who believe, do not take certain Jews and Christians as allies; these are allies of one another. Those among you who ally themselves with these belong with them. GOD does not guide the transgressors. (5:51)—
হে মুমিনগণ! তোমরা ইয়াহুদী ও নাসারাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে নিশ্চয় তাদেরই একজন [১]। নিশ্চয় আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না।
এক্ষেত্রে তরজমাতে certain- শব্দটি কেউ কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে উহ্য রাখেন।
You would see many of them allying themselves with those who disbelieve. Miserable indeed is what their hands have sent forth on behalf of their souls. GOD is angry with them and, consequently, they will abide forever in retribution.(5:80) —
তাদের অনেককে আপনি কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন। তাদের অন্তর যা তাদের জন্য পেশ করেছে (তাদের করা কাজগুলো) কত নিকৃষ্ট! যে কারণে আল্লাহ তাদের উপর রাগান্বিত হয়েছেন। আর তারা আযাবেই স্থায়ী হবে।
এখানে who disbelieve- বলতে প্রকৃত ধর্মপ্রাণ ইহুদী এবং খ্রীস্টানদের বলা হয় নি, সেটা আমি আগেই ব্যাখ্যা করেছি ।}
তাহলে আল্লাহ কোরআনে বলতেন না-
“And (Lawful in marriage are) chaste women from among the believers and chaste women from among those who were given the Scripture before you” [Holy Quran: Surah Al-Maidah 5:5]
আজ [১] তোমাদের জন্য সমস্ত ভাল জিনিস হালাল করা হল [২] ও যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে [৩] তাদের খাদ্যদ্রব্য তোমাদের জন্য হালাল এবং তোমাদের খাদ্যদ্রব্য তাদের জন্য বৈধ। আর মুমিন সচ্চরিত্রা নারী ও তোমাদের আগে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের সচ্চরিত্রা [৪] নারীদেরকে তোমাদের জন্য বৈধ করা হল [৫] যদি তোমরা তাদের মাহর প্রদান কর বিয়ের জন্য, প্রকাশ্য ব্যভিচার বা গোপন প্রণয়িনী গ্রহণকারী হিসেবে নয়। আর কেউ ঈমানের সাথে কুফরী করলে তার কর্ম অবশ্যই নিস্ফল হবে এবং সে আখেরাতে ক্ষীতগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে [৬]।
এখানে কিন্তু those who were given the Scripture before you- বলতে ইহুদী এবং খ্রীস্টাদেরকেই বোঝানো হয়েছে। আমি যদি তাদের সাথে বন্ধুত্বই না রাখতে পারি, তাহলে তাদেরকে বিয়ে করার অনুমতি দিলো কেনো কোরআনে?
অনেকে বলে থাকেন, কোরআনে বাবা বা মা অবিশ্বাসী হলে (লক্ষ্য করুন, বলছে না যে, বাবা বা মা যদি প্রকৃত ধর্মপ্রাণ ইহুদী এবং খ্রীস্টান হয়) বিশ্বাসী সন্তানকে বলা হয়েছে না কি তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার জন্য। উদাহরণ দেওয়া হয় নিচের আয়াতটির—
O you who believe, do not ally yourselves even with your parents and your siblings, if they prefer disbelieving over believing. Those among you who ally themselves with them are transgressing. (9:23)
হে ঈমানদারগণ ! তোমাদের পিতৃবর্গ ও ভাতৃবৃন্দ যদি ঈমানের মুকাবিলায় কুফরীকে পছন্দ করে, তবে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহন করো না [১]। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহন করে তারাই যালিম।
তারা কিন্তু এর পরের আয়াতটি কখনো উল্লেখ করবে না, যেটা হলো—
If your parents, your children, your siblings, your spouses, your family, the money you have earned, a business you worry about, and the homes you cherish are more beloved to you than GOD and His messenger, and the striving in His cause, then just wait until GOD brings His judgment.” GOD does not guide the wicked people. (9:24)
বলুন, ‘তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ্, তাঁর রাসূল এবং তাঁর (আল্লাহ্র) পথে জিহাদ করারা চেয়ে বেশি প্রিয় হয় [১] তোমাদের পিতৃবর্গ, তোমাদের সন্তানেরা, তোমাদের ভ্রাতাগণ, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের আপন গোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশংকা কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমার ভালবাস [২], তবে অপেক্ষা কর আল্লাহ্ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত। [৩]’ আর আল্লাহ্ ফাসিক সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেনা না [৪]।
এ প্রসঙ্গে কোরআনে আরো আছে—
We enjoined man to show kindness to his parents, for with much pain his mother bears him, and he is not weaned before he is two years of age. We said: ‘Give thanks to Me and to your parents. To me shall all things return. But if they press you to serve besides Me deities you know nothing of, do not obey them. Be kind to them in this world, and follow the path of those who turn to Me. To Me you shall return, and I will declare to you all that you have done.’( S. 31:14-15; cf. 29:8)
আর আমরা মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভ ধারণ করে, আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে। কাজেই আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও [১]। ফিরে আসা তো আমারই কাছে।
আর তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে শির্ক করার জন্য পীড়াপীড়ি করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই [১], তাহলে তুমি তাদের কথা মেনো না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে বসবাস করবে সদ্ভাবে [২] আর যে আমার অভিমুখী হয়েছে তার পথ অনুসরণ কর। তারপর তোমাদের ফিরে আসা আমারই কাছে, তখন তোমরা যা করতে সে বিষয়ে আমি তোমাদেরকে অবিহিত করব।
আর আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে [১]। তবে তারা যদি তোমার উপর বল প্রয়োগ করে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করতে যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই [২], তাহলে তুমি তাদেরকে মেনো না [৩]। আমারই কাছে তোমাদের ফিরে আসা। অতঃপর তোমরা কি করেছিলে তা আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব [৪]।
এই আয়াতগুলোর ব্যবহার তারা কখনো করতে চায় না, কেনো?
ইসলাম কখনোই ধর্মান্ধতা বা অসহনশীলতাকে প্রশ্রয় দেয় না। এ ব্যাপারেও কোরআনে বলা হয়েছে–
We have sent down the Book to you in truth, verifying what is before it of the Book and a standard of comparison for it; therefore judge between them by what God has sent down, and do not follow their low desires, turning away the truth that has come to you; for each of you we have ordained a law and a way of doing things. If God wished, He would have made you a single community, but he tests you according to what he has given you, so compete with each other in doing good. Your return is to God, and then He will let you know about that in which you differed. (Qur’an 5:48)
আর আমরা আপনার প্রতি সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছি ইতোপূর্বেকার কিতাব সমূহের সত্যতা প্রতিপন্নকারী ও সেগুলোর তদারককারীরূপে [১]। সুতরাং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী তাদের বিচার নিষ্পত্তি করুন এবং যে সত্য আপনার নিকট এসেছে তা ছেড়ে তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবেন না [২]। তোমাদের প্রত্যেকের জন্যই আমরা একটা করে শরীয়ত ও স্পষ্টপথ নির্ধারণ করে দিয়েছি [৩]। আর আল্লাহ ইচ্ছে করলে তোমাদেরকে এক উম্মত করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা দিয়ে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান। কাজেই সৎকাজে তোমরা প্রতিযোগিতা কর। আল্লাহর দিকেই তোমাদের সবার প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ করছিলে, সে সম্বন্ধে তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন।
তাই পরিশেষে আমি বলতে চাই, আমার এই স্বল্প বিদ্যায় আমি কোরআনের কোথাও দেখেনি – কোরআন প্রকৃত ধর্মপ্রাণ ইহুদীদেরকে ঘৃনা করতে শেখায় বা ইহুদীদেরকে apes and swine বলেছে। বরং কোরআনে ইহুদীদের সম্পর্কে আমরা ভালো কথাই দেখতে পাই, যেমন দেখতে পাই প্রকৃত ধর্মপ্রাণ খ্রীস্টানদের নিয়েও, (কোরআনে ঈসার মা বিবি মরিয়মকে নিয়েও একটি সুরা আছে)।
পর্ব ২
২:৬২
ইহুদি >নাসারা>সাবেয়ী >সত্যেরসন্ধানে >সরলদ্বীন >ফিতরাতাল্লাহ >৫ঃ৬৯ >৩০ঃ৩০
ইহুদি নাসারা বলতে কি বুঝায় কুরআনে?
(৫ঃ৬৯)
প্রচলিত অনুবাদঃ
“মু’মিনগণ, ইহুদিগণ (হাদু), সাবীগণ ও নাসারাদের মধ্যে কেহ আল্লাহ্ ও আখিরাতে ঈমান আনিলে এবং সৎকর্ম করিলে (আমিলু সাহিলা) তাহাদের কোন ভয় নেই এবং তাহারা দুঃখিতও হইবে না ।”-(মায়িদা:69)
ইহুদী শব্দটার মূল হুদা থেকে এসেছে, যার অর্থ Guidance/পথপ্রদর্শন। ইয়াহুদ শব্দটি হলো হুদা (বিশেষ্য) এর verb.
যেমন সালাত এর verb হলো ইয়ুসাল্লু।
তো ইয়াহুদ শব্দের অর্থ, পথ প্রদর্শন করা
(৫ঃ৬৯) এ হাদু শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যা হুদা এর Adjective/বিশেষণ। যার অর্থ হলো পথপ্রদর্শক। প্রচলিত অনুবাদে হাদু শব্দকে ইহুদি অনুবাদ করেছে।
নাসারা শব্দটার অর্থও খ্রীস্টান নয়। নাসির শব্দের অর্থ সাহায্যকারী (Singular) আর plural হলো নাসারা। ২ঃ১০৭, ২ঃ১২০, ৪ঃ৪৫, ৩০ঃ২৯ সহ অসংখ্য আয়াতে এই নাসির শব্দটি আছে।
যেমন (২ঃ১০৭)
“তুমি কি জানো না যে, আল্লাহর জন্যই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের আধিপত্য? আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোন বন্ধু ও সাহায্যকারী (নাসির) নেই।”
সাবি শব্দের ধাতু সোয়াদ-বা-হামজা এর মূল অর্থ হলো “যারা এক জীবনবিধান থেকে অন্য জীবনবিধানে পরিবর্তিত হয়।”
অর্থাৎ সাবিইন এর অর্থ হতে পারে পরিবর্তনকারীরা (Change makers) (plural)
অর্থাৎ (৫ঃ৬৯) এর সঠিক অনুবাদ হবে
“মুমিনগণ, পথপ্রদর্শকেরা (হাদু), পরিবর্তনকারীগণ (সাবিইন) ও সাহায্যকারীদের (নাসারা) মধ্যে কেউ আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান আনলে এবং ভারসাম্য রক্ষা করলে (আমিলু সালিহা) করলে তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।”
মুসলিম, ইহুদি, খ্রীস্টান- এগুলো মানব তৈরি ধর্ম। আল্লাহর কাছে এসব ধর্মের কোনো অস্তিত্বই নেই। অতীতের কিতাব প্রাপ্তদের কুরআনে “আহলে কিতাব” বলা হয়, ইহুদি-খ্রীস্টান নয়।
আর যারা মুসলিম, ইহুদি, খ্রীস্টান ধর্ম বানিয়ে নিজেদের বিভক্ত করেছে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেনঃ
(৬:১৫৯)
নিশ্চয় যারা তাদের দ্বীন বিচ্ছিন্ন করেছে এবং দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের কোন ব্যাপারে তোমার দায়িত্ব নেই। তাদের বিষয়টি তো আল্লাহর নিকট। অতঃপর তারা যা করত, তিনি তাদেরকে সে বিষয়ে অবগত করবেন।
(৩:১০৫)
আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা বিভক্ত হয়েছে এবং মতবিরোধ করেছে তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন সমূহ আসার পর। আর তাদের জন্যই রয়েছে কঠোর আযাব।
৬ঃ১৫৯ এ উল্লেখিত আল্লাহর একমাত্র মনোনীত দ্বীন/System হলো ফিতরাতাল্লাহ (আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধান)। আসেন ৩০ঃ৩০-৩২ পর্যন্ত পড়ি একটু।
(৩০ঃ৩০) “তুমি একনিষ্ঠ ভাবে নিজেকে সত্য অনুসন্ধানের (হানিফা) উপর প্রতিষ্ঠিত (আক্বিম) রাখ। এটাই আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধান (ফিতরাতাল্লাহ), যার ভিত্তিতে তিনি মানবজাতিকে (নাস) সৃষ্টি (ফাতারা) করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল ধর্ম (দ্বীন)। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।”
অর্থাৎ আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধানই হলো সত্য অনুসন্ধান, যে সত্য বিধানের উপরে ভিত্তি করে পুরো মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ। এটাই সরল দ্বীন, যা অধিকাংশ জানেনা।
(৩০ঃ৩১) ”সবাই তাঁর অভিমুখী হও এবং সংযোগ স্থাপন (ইত্তাকু) কর, সালাত প্রতিষ্ঠা কর এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।
(৩০ঃ৩২) “তাদের মতো হয়ো না যারা তাদের দ্বীনে বিভেদ সৃষ্টি করেছে এবং অনেক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উল্লসিত।”
অর্থাৎ আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধানই হলো সরল দ্বীন। আল্লাহর নির্দেশ একেবারে সরল।
১) আল্লাহর এই সরল দ্বীনে/সত্য অনুসন্ধানে/প্রাকৃতিক বিধানে প্রতিষ্ঠিত হতে বলেছেন,
২) মুত্তাকি হতে বলেছেন (আল্লাহর সাথে সংযোগ স্থাপন করতে বলেছেন)।
৩) সালাত প্রতিষ্ঠা করতে বলেছেন (আল্লাহর সকল বিধান যথাযথ পালন করা)
৪) শিরক করতে নিষেধ করেছেন
৫) আল্লাহর সরল দ্বীনকে বিভক্ত করতে নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ নিজেদের ইহুদি, খ্রীস্টান, মুসলিম ধর্মের অনুসারী নামকরণ করে আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধানকে (যার ভিত্তিতে সমগ্র মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন) বিভক্ত করতে নিষেধ করেছেন। যারাই নিজেদের আল্লাহর সরল দ্বীনে প্রতিষ্ঠিত করবে, অনুসরণ করবে, তারাই মুসলিম। এটি আলাদা কোনো ধর্ম নয়।
আমরা মানুষকে বর্ণ, রং, ধর্ম ইত্যাদি বিভিন্ন দলে ভাগ করি। আল্লাহর দৃষ্টিতে সবাই সমান, সবাই আল্লাহর সৃষ্টি (ফাতারা)। মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করার অর্থই হলো আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধানকে/সরল দ্বীনকে বিভক্ত করা। যারা এই বিভক্তের কাজ করে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কঠোর আযাব (৩ঃ১০৫)
Hud 11:53)
يَٰهُودُ
ইয়াহুদ, অর্থ হে হুদ, একজন নবীর নাম,
Al-Baqarah 2:2)
هُدًى
হুদা, অর্থ সৎপথ,
يَٰهُودُ
আবার ইয়াহুদ অর্থ দিয়ে ইয়াহুদী জাতীকে বুঝানো হয়েছে,
Al-Baqarah 2:214)
نصر
নাসার, থেকে নাছরিন, নাছির,নাছরু, যার অর্থ সাহায্য,
ٱلنَّصَٰرَىٰ অর্থ সাহায্যকারী
নিচের আয়াত দেখুন,
বলা হয়েছে, যারা মুমিন,(বিশ্বাসী) ইয়াহুদী,(সৎপথের)নাসারা(সাহায্যকারী)
সাবেঈনদের মধ্যে যারা ঈমান বিশ্বাস এনেছে, আল্লাহর ও শেষ দিনের প্রতি, এবং সৎকর্ম করেছে, – তবে তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট তাদের প্রতিদান। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।
উক্ত আয়াতে বুঝলাম, মুমিন হলে আল্লাহর প্রতিদান জান্নাত পাওয়া যাবে না,। আবার ইয়াহুদী, নাসারা, হলে জাহান্নামে যাবে না,
তাহলে নিচের আয়াতের কি হবে
Hud 11:53)
قَالُوا۟ يَٰهُودُ مَا جِئْتَنَا بِبَيِّنَةٍ وَمَا نَحْنُ بِتَارِكِىٓ ءَالِهَتِنَا عَن قَوْلِكَ وَمَا نَحْنُ لَكَ بِمُؤْمِنِينَ
তারা বলল, ‘হে হূদ, তুমি আমাদের কাছে কোন স্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে আসনি, আর তোমার কথায় আমরা আমাদের উপাস্যদের ত্যাগ করব না এবং আমরা তোমার প্রতি বিশ্বাসীও নই’।
Al-Baqarah 2:62-62
(62) إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَٱلَّذِينَ هَادُوا۟ وَٱلنَّصَٰرَىٰ وَٱلصَّٰبِـِٔينَ مَنْ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلْءَاخِرِ وَعَمِلَ صَٰلِحًا فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ
নিশ্চয় যারা মুমিন হয়েছে, যারা ইয়াহূদী হয়েছে এবং নাসারা ও সাবেঈন যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি এবং নেক কাজ করেছে – তবে তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট তাদের প্রতিদান। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।
,,,,,,,,,,,
আমি যেটা বলতে চাচ্ছি ইয়াহুদ, নাসারার অর্থ আগে জানতে হবে, বুঝতে হবে তারপর তাদের নিয়ে বিতর্ক করতে হবে।
তবে, আল্লাহ যাদের জাহান্নামি হিসেবে ঘোষনা করছেন, তারা হলো
এদের মধ্যে হতে, যারা মুশরিক, মুনাফিক, কাফির,যালিম, পাপাচারী,সীমালঙ্ঘনকারী, তারাই জাহান্নামের অধিবাসী।
ইহুদি ও খ্রিস্টানরা কখনোই সালামুন আলা মুসা ও সালামুন আলা ঈসা এর অনুসারী ছিলেন না,বরং তাদের অনুসারীগণ ছিলেন মুসলিম(আত্মসমর্পণকারী) ! (১০:৯০ ও ৩:৫২)
1.আর তারা বলে, ইয়াহূদী কিংবা নাসারা ছাড়া অন্য কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এটা তাদের মিথ্যা আশা। বল, ‘তোমরা তোমাদের প্রমাণ নিয়ে আস, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক’। হ্যাঁ, বরং যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে আর সৎকর্মশীল হয়, তার জন্য তার রবের নিকট পুণ্যফল রয়েছে, তাদের কোন ভয় নেই, তাদের কোন দুঃখ নেই। (2:111,112)
2.আর ইয়াহূদীরা বলে, ‘নাসারাদের কোন ভিত্তি নেই’ এবং নাসারারা বলে ‘ইয়াহূদীদের কোন ভিত্তি নেই’। অথচ তারা কিতাব পাঠ করে। এভাবেই, যারা কিছু জানে না, তারা তাদের কথার মত কথা বলে। সুতরাং যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করত আল্লাহ কিয়ামতের দিন সে বিষয়ে তাদের মধ্যে ফয়সালা করবেন।(2:113)
3.আর তারা বলে, ‘তোমরা ইয়াহূদী কিংবা নাসারা হয়ে যাও, হিদায়াত পেয়ে যাবে’। বল, ‘বরং আমরা ইবরাহীমের মিল্লাতের অনুসরণ করি, যে একনিষ্ঠ ছিল এবং যে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না’। (2:135)
- যে নিজেকে নির্বোধ করিয়াছে সে ব্যতীত ইব্রাহীমের ধর্মাদর্শ হইতে আর কে বিমুখ হইবে। পৃথিবীতে তাহাকে আমি মনোনীত করিয়াছি; আর আখিরাতেও সে অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণগণের অন্যতম।(2:130)
আমি, আল্লাহর আয়াতে বিশ্বাসী একজন মুসলিম(আত্মসমর্পণকারী) (43:69)(27:81)(30:53)। আমি একজন মুসলিম (আত্মসমর্পণকারী) একমাত্র আল্লাহর কিতাব আল কোরআন মেনে চলি কারণ আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন…
ইব্রাহীম আঃ ইহুদিও ছিল না , খ্রিস্টানও ছিল না , বরং তিনি ছিলেন একনিষ্ট মুসলিম(আত্মসমর্পণকারী) ।
তেমনি নবী আহমদ শিয়া,সুন্নি ছিল না, হানাফি , সাহাফি, মালেকী, হান্বলী ,আহলে হাদিস, শিচতিয়া, নকশবন্দিয়া, দেওবন্দিয়া ছিল,না, তিনি ছিলেন একনিস্ঠ মুসলিম(আত্মসমর্পণকারী) ,,,
ইব্রাহীমের ধর্ম কওমের অনুসারীদের নামও ছিল মুসলিম ,কিন্ত তারা নিজেদের মুসলিম পরিচয়ের চেয়ে ইহুদি, খ্রিস্টান পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়েছে ,
ঠিক তেমনি নবী আহমদের এর অনুসারীদের নাম ও পরিচয় থাকার কথা মুসলিম(আত্মসমর্পণকারী) , কিন্ত তারা এই পরিচয়ের চেয়ে নিজেকে শিয়া, সুন্নি , হানাফি , মালেকী, হান্বলী,আহলে হাদিস, শিচতিয়া, নকশবন্দিয়া, দেওবন্দিয়া,মাজার পূজারি,পীর পূজারি মুসলমান পরিচয় দিতে সাচ্ছন্দ্য পায়।।
সৃষ্টির শুরু থেকে পৃথিবীর সকল নবী ও রাসূলগণের ছিলেন মুসলিম (আত্মসমর্পণকারী)
- সালামুন আলা নুহু ছিলেন মুসলিম(আত্মসমর্পণকারী)! (10:72)
- সালামুন আলা ইব্রাহিম ছিলেন মুসলিম(আত্মসমর্পণকারী)! (2:131,132)(22:78)
- সালামুন আলা লুত ছিলেন মুসলিম(আত্মসমর্পণকারী)! (51:35-35)
- সালামুন আলা ইয়াকুব ছিলেন মুসলিম(আত্মসমর্পণকারী! (2:133)
- সালামুন আলা ইউসুফ ছিলেন মুসলিম(আত্মসমর্পণকারী) ! (12:101)
- সালামুন আলা মুসা ছিলেন মুসলিম(আত্মসমর্পণকারী) (10:84)
- যাদুকরেরা মুসলিম(আত্মসমর্পণকারী) হয়েছিলেন(7:126)
- ফেরাউন মুসলিম(আত্মসমর্পণকারী) হতে চেয়েছিলেন (10:90)
- সালামুন আলা সুলাইমান ছিলেন মুসলিম(আত্মসমর্পণকারী) (27:30,31,38)
- সাবারানী মুসলিম(আত্মসমর্পণকারী) হয়েছিলেন (7:126)
- সালামুন আলা ইসা ও তার সঙ্গী সাথীরা ছিলেন মুসলিম(আত্মসমর্পণকারী) (3:52,5:111)
- সালামুন আলা আহমদ ও তার সঙ্গী সাথীরা ছিলেন মুসলিম(আত্মসমর্পণকারী)
(6:14,163)(27:91)(39:12)(11:14)(29:46)(21:108)(3:64) - জিন জাতিরা ও মুসলিম (আত্মসমর্পণকারী) ছিলেন (72:13-15)
- আপনি ,আমি ও আমাদের সবাইকে মুসলিম (আত্মসমর্পণকারী) বলে পরিচয় দিতে হবে|
(41:33)(2:136)(3:84)(46:15)(16:89,102)(30:52,53)(27:80,81)(43:68-70) ইহুদি খ্রিস্টান হিন্দুদের মাঝে একটা দল জান্নাত যাবে,তাদের গুনাবলি ৩ঃ১১৩-১১৬ এবং ২ঃ৬২
সূরা ৩. আলে-ইমরান আয়াত নং ১১৩-১১৬
অনুবাদঃতারা সবাই সমান নয়। আহলে কিতাবদের কত লোক এমনও আছে যারা দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত আছে, তারা রাত্রিকালে আল্লাহর আয়াত সমূহ পাঠ করে থাকে এবং তারা সাজদাহ /মান্য করে থাকে।তারা আল্লাহর ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস পোষণ করে, সৎকাজের আদেশ দেয় এবং অসৎকাজ হতে নিষেধ করে এবং কল্যাণকর কাজে তৎপর থাকে। বস্তুতঃ তারা পুণ্যবানদের মধ্যে গণ্য। তারা যা কিছু সৎকাজ করুক কোন কিছুই প্রত্যাখ্যান করা হবে না এবং আল্লাহ মুত্তাকীদের বিষয়ে বিশেষরূপে পরিজ্ঞাত।
সূরা ২. আল-বাকারা আয়াত নং ৬২
অনুবাদঃ নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে, যারা ইয়াহূদী হয়েছে এবং নাসারা ও সাবিঈরা* -(তাদের মধ্যে) যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি এবং নেক কাজ করেছে – তবে তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট তাদের প্রতিদান। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। -(আল-বায়ান)