নবী ইব্রাহিমের কথিত কুরবানী –
(৩৭:১০২) “অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখিযে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখো। সে বললঃ পিতাঃ! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন”।
(৩৭:১০২) তে ইব্রাহিম তার ছেলেকে এক জায়গায় ফেলে রেখে গিয়েছে তার ছিটেফোঁটাও নেই। বরং বলা হচ্ছে যখন তার ছেলে সফর করার বয়সে পৌঁছালো।
6 (137) :”এমনিভাবে অনেক মুশরিকের দৃষ্টিতে তাদের উপাস্যরা সন্তান হত্যাকে সুশোভিত করে দিয়েছে”……
এখানে “মুশরিকিন ” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। পূর্বে এক সময়ে মানুষ ধর্মীয় রীতি মনে করে সন্তান হত্যা করতো, দেবদেবীকে খুশি করার জন্য। আর আমরাতো কোরানে পড়েছি ইব্রাহিমতো “মুশরিক” ছিলনা।
আল্লাহ কাউকে খারাপ কাজের আদেশ দেন না (৭:২৮)। সুতরাং খারাপ কাজের আদেশ দিয়ে কাউকে পরীক্ষা করার প্রশ্নই আসেনা।
১। আল্লাহ মন্দ কাজের আদেশ দেন না (৭:২৮)
২। শয়তান মন্দ কাজের আদেশ দেয় (২:২৬৮)
৩। শয়তান সবসময় নবী রাসূলদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে, কিন্ত আল্লাহ সেই চেষ্টা নষ্ট করে দেন। (২২:৫২)
৪। বিশ্বাসীদের হত্যা করা মন্দ কাজ এবং এর পরিনাম জাহান্নাম (৪:৯২,৯৩)।
নবী ইব্রাহিম স্বপ্ন দেখার পর এটা আল্লাহ প্রদত্ত ভেবেছিলেন, সেজন্য এই স্বপ্ন পূর্ণ করতে গিয়েছিলেন যেখানে আল্লাহ এই আদেশ দেননি। সুতরাং এটা তার ওপর পরীক্ষা ছিল যে, আল্লাহর আদেশ মনে করে সে এই কাজ করবে কিনা?
কোথায় বলা হয়েছে নবী ইব্রাহিমের পুত্রের বদলে আল্লাহ একটা ভেড়া পাঠিয়ে দিয়েছেন? একটা ভেড়া/ দুম্বা কিভাবে নবী ইব্রাহিমের পুত্রের জীবনের বদলে great slaughter হয়?
৩৭:১০২ আছে “তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখিযে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখো”- এই বাক্যটুকু দ্বারা বুঝা যায় যে স্বপ্ন দেখার পর নবী ইব্রাহিম কিছুটা কনফিউসড ছিল। কারন যদি তিনি সম্পূর্ণ ভাবে নিশ্চিত হতেন যে এটা আল্লাহর আদেশ তবে সে এই বিষয়ে ছেলের অভিমত জানতে চাইতেন না। সে সরাসরি আদেশ বাস্তবায়ন করতেন। কিন্তু এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি উনি নিশ্চিত না, সেজন্য সে তার ছেলের আভিমত জানতে চেয়েছেন।
আল্লাহ নবী ইব্রাহিমের পুত্রের বলি/কোরবানির বদলে কি দিয়েছেনঃ (৩৭:১০৭) “আমি তার পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার জন্যে এক মহান জন্তু”।
এবার আসুন আমাদের মুসলমানদের মধ্যে গল্প চালু আছে যে, নবী ইব্রাহিমের ছেলের পরিবর্তে আল্লাহ একটা ভেড়া / দুম্বা পাঠিয়ে দিয়েছেন। ইব্রাহিম ঐ ভেড়া জবাই করেছেন তার উৎসও বাইবেল। কোরআনে এই ধরনের কোনো কথা বলা হয় নি।
৩৭:১০৭ নং আয়াতে তিনটি শব্দ এসেছে। প্রথম শব্দ وَفَدَيْنَاهُ বা “ফাদাইনাহ” এর অর্থ concession or ransom ( ছাড়/ মুক্তিপন)। এর অর্থ কোনভাবেই কোরবানি বা স্যক্রিফাইস না। এর জন্য ২:১৯৬ দেখুন।
দ্বিতীয় শব্দঃ بِذِبْحٍ “বিজিবিহিন” অর্থ “with slaughter” or “in place of slaughter” ৩৭:১০৭ এর অর্থ অনুযায়ী এই slaughter দ্বারা নবী ইব্রাহিমের পুত্রকে জবাই করা অর্থে বোঝানো হয়েছে, অন্য কোন প্রানী বা ভেড়া কে বুঝানো হয়নি। কারন ৩৭:১০২ এ أَذْبَحُكَ শব্দ দ্বারা নবী ইব্রাহিমের পুত্রকে জবাই করা অর্থে বোঝানো হয়েছে। তাহলে ৩৭:১০৭ এ কেন অন্য প্রানী বা ভেড়া জবাই করা উদ্দেশ্যে এই শব্দ ব্যবহার হবে, যেখানে কোথাও এই ধরনের প্রানীর অস্তিত্ব নেই।
তৃতীয় শব্দঃ عَظِيمٍ শব্দের অর্থ Great।
এখন কোরআনের প্রেক্ষিতে এই তিনটি শব্দের অনুবাদ করলে যা অর্থ দাড়ায় তা হলো, যদিও এই আদেশ আল্লাহর পক্ষ থেকে ছিলোনা, তবু নবী ইব্রাহিম এটাকে আল্লাহর আদেশ ভেবে তার সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে জবাই করতে উদ্যত হতে দ্বিধা করেননি। সেজন্য ৩৭ঃ১০৫, ১১০-১১ অনুযায়ী আল্লাহ নবী ইব্রাহিমের প্রতি তার আল্লাহ ভক্তির কারনে খুশি হয়ে আল্লাহ সরাসরি হস্তক্ষেপে নবী ইব্রাহিম কে একটা বড় পাপ কাজ (৪:৯৩)থেকে রক্ষা করেন এবং তার পুত্রকেও জবাই হওয়া থেকে রক্ষা করেন । এরকম ঘটনার আরও উদাহরণ হচ্ছে সূরা ইউসুফ যেখানে নবী ইউসুফ কেও আল্লাহ সরাসরি পাপ কাজ থেকে বিরত রেখেছিলেন (১২:২৪)।
এর আগের আয়াতে ৩৭/৬৯ নং আয়াতে পূর্ব পুরুষদের কর্মের কথা বলা হয়েছে। ৩৭/৭৫ ( নূহের কথা), ৩৭/৮৩-১১২ (ইব্রাহিমের কথা), ১১৪( মূসার কথা), ১২৩( ইলিয়াসের কথা), ১৩৩( লূতের কথা), ১৩৯ এ ইউনুসের কথা সহ এই সূরায় বেশ কিছু মেসেঞ্জার এর কথা বলা হয়েছে।
37:আস-সাফ্ফাত:108
وَ تَرَكْنَا عَلَیْهِ فِی الْاٰخِرِیْنَۖ
এবং পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে চিরকালের জন্য তার প্রশংসা রেখে দিলাম।
অর্থাৎ, আমরা তাকে পরবর্তীদের জন্য এক্সাম্পল রাখলাম। তারাক(না) – এই ‘ না’ শব্দটিকে তারা কুরবানী মিন করে।
অথচ এখানে ইব্রাহিমকে মিন করে। এই তারাকনা শব্দটি আরও এসেছে বিভিন্ন জায়গায়। যেমন : নূহের উদাহরন দিয়ে আল্লাহ বলেছেন –
37:আস-সাফ্ফাত:78
وَ تَرَكْنَا عَلَیْهِ فِی الْاٰخِرِیْنَ٘ۖ
“এবং পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে তারই প্রশংসা ছেড়ে দেই।”
এখানেও কিন্তু নূহের উদাহরনে এই একই ( তারাকনা) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কই এখানে তো এই তারাক( না) শব্দটি দিয়ে কুরবানী মিন করেনা। এরকম আরও অনেক আয়াতে এই শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
এবার আসা যাক ( নাজজী) পুরস্কার কি?
এই নাজজী বা পুরস্কার শুধু ইব্রাহিমকে দেয়া হয়নি। আরও মেসেনজারকে দেয়া হয়েছে যেমন: ৩৭/৮০( নূহকে), ১০৫,১১০ ( ইব্রাহিমকে বলা হচ্ছে। ১২১ ( মূসা ও হারুনকে), ১৩১ নং আয়াতে ইলইয়াসিন সহ প্রত্যেক রাসূল যাদের কথা বর্ননা করা হয়েছে, সবার ক্ষেত্রে এই ( নাজজী) শব্দ রয়েছে এখানে।
নূহ এবং নূহের নৌকায় যারা ছিল তাদেরকে যে আল্লাহ রক্ষা করেছে এটা কি নূহের জন্য নাজজী বা পুরস্কার নয়?
মুসা এবং হারুনকে আল্লাহ ফেরাউন থেকে রক্ষা করে সাগর পার করেছে এটাকি তাদের জন্য নাজজী ( পুরস্কার) নয়?
৬(৭৪-৯৯) পর্যন্ত পড়লে দেখা যায় ইব্রাহীমের ওপর (৮৩-৯৯) কি পরীক্ষা হয়েছে। ওনাকে যখন আগুন থেকে বাঁচানো হলো এটা কি তার জন্য নাজজী বা পুরস্কার নয়? ১১২ তে তাকে একটি সালেহীন বাচ্চা দিয়েছেন। ১০১ এ বলেছেন গুলামিন হালিম দিয়েছেন। এটা কি তার জন্য নাজজী (পুরস্কার) নয়?
৩৭/১০৫ এ বলছে, তুমি স্বপ্নকে সত্যি বলে বিশ্বাস করছো!!(Exclamatory sentence) ( বিস্ময় প্রকাশ করলো!! )।
ভুল অনুবাদ হচ্ছে, “তুমিতো স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছো”। আচ্ছা যদি বাস্তবায়িত হয়েই থাকে তাহলে তো ছেলেকে জবাই করে ফেলেছে তাই না? বাস্তবায়িত এর আরবি এটা নয়। ১০৬ এ এটা তার জন্য বড় পরীক্ষা ছিল।
এখানে কোথায় বলা হয়েছে তোমার প্রিয় বস্তু কোরবানি করো? “প্রিয় বস্তু”- এই শব্দটা এই আয়াতে কোথায় আছে? অথবা কোরআনের অন্য কোথায় কোন আয়াতে আল্লাহ ইব্রাহিম নবীকে তার প্রিয় বস্তু কোরবানি করার কথা বলেছেন? এখানে “যবেহ” শব্দটি আছে । এখানে কোরবানি বলে কোন শব্দ নেই।
যবেহ”- শব্দ দ্বারা কোরবানি বুঝানো হয়েছে বা এটা যবেহ শব্দের সমার্থক কোরআনের প্রেক্ষিতে এটা ভাবার কোন সুযোগ নেই। কেনো নেই? কারন কোরবানি বলতে আপনি যা বুঝেন সেই অর্থে এই কোরবানি শব্দটি কোরআনের ৫:২৭ এবং ৩:১৮৩ আয়াতে “কোরবানি” শব্দ হিসাবেই ব্যবহার হয়েছে। তাহলে আল্লাহ কোরবানি এবং যবেহ দুইটা পৃথক শব্দ ব্যবহার করেছেন কেনো? আল্লাহ যদি কোরবানি চাইতো তাহলে এই ৩৭:১০২ এ “যবেহ” শব্দটি ব্যবহার করতোনা, কোরবানি শব্দ ব্যবহার করতো। এরপরেও যদি মানুষ কোরবানি করার কথা বলে, তবুও এটা মন্দ কাজ।
কিন্তু যে দুইটি মুল পয়েন্ট আমি বলতে চাচ্ছি কোরআন অনুযায়ী তা হচ্ছে –
১। আল্লাহ এই আদেশ দেননি।
২। কোন ভেড়া বা অন্য কোন প্রাণী স্বর্গ থেকে ইব্রাহিমের পুত্রের বদলে জবাই করতে পাঠাননি।