সূরাটির সার শিক্ষা এবং সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
★ধারাবাহিক #
প্রথম=পর্ব ★
[بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ]শানে নজুল এবং আনুষঙ্গিক বক্তব্যঃ-
খ্রিস্টধর্মাবলম্বী সাতজন (?) যুবক তৌহিদ ধর্ম পালনের অপরাধে ধর্মদ্রোহী রাজশক্তি কর্তৃক প্রাণদণ্ড বিধানের ভয়ে পালাইয়া গিয়া কাহাফে’ অর্থাৎ ‘পর্বত গুহায় আশ্রয় লইয়াছিলেন। সেইখানে এক ‘ঘুম’-এর পর যখন তাহারা জাগিলেন এবং তাঁহার বাহিরে আসিলেন তখন লােকেরা জানিতে পারিল যে, তিনশত বৎসর (চন্দ্রমাস অনুসারে ৩০৯ বৎসর) সেই অবস্থায় অতিবাহিত হইয়া গিয়াছিল।
কেমন করিয়া এত শতবর্ষ অতীত হইয়া গিয়াছিল গুহাবাসী যুবকগণ নিজেরাও ঠাহর করিতে পারেন নাই, কারণ তাহাদের মনে হইয়াছিল যেন একদিন অথবা তাহার একাংশ মাত্র তাহারা সেই অবস্থায়
অতিবাহিত করিয়াছিলেন।।
জনসাধারণ এই রহস্যময় ঘটনা অবগত হওয়ার পর আশ্চর্যান্বিত হইয়া গেল এবং তাহা কেমন করিয়া সম্ভব হইতে পারে উহা লইয়া তুমুল আলােচনা চলিতে লাগিল। দেশ ও রাজশক্তি এই সময় ছিল খ্রিস্টধর্মের সমর্থক। অবশেষে সকলে এই ঘটনার স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণ করিয়া রাখিবার জন্য আলােচনা করিতে লাগিল।
একদল বলিল, “চলাে, আমরা একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করিয়া এই অলৌকিক ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করিয়া রাখি।
” আর একদল এই যুক্তি দিল, কোনােরূপ স্মৃতিসৌধ যেহেতু এইরূপ মহান ঘটনার উপযুক্ত স্মৃতিচিহ্ন হইতে পারে না এবং উহা আল্লাহর পছন্দনীয় হইতেও পারে না, সেহেতু ‘চল, আমরা বিশেষ করিয়া
তাহাদের (এইরূপ জীবন আদর্শের) উপর মসজিদকেই ধরিয়া লই (১৮:২১)।
এই জাতীয় মত বিরােধের পরিণামে শেষোক্ত দলের সিদ্ধান্তই জয়যুক্ত হইল, অর্থাৎ তাহা গ্রহণ করা হইল।।
এই বাক্যের ব্যাখ্যা করিতে যাইয়া সবাই একবাক্যে বলিবেন যে, মসজিদ তৈরি করিবার সিদ্ধান্তই জয়যুক্ত হইল এবং অন্যান্য প্রকারে স্মৃতিরক্ষার প্রস্তাব বাতিল করা হইল। যেহেতু কোরাআন মসজিদ গৃহকে আল্লাহর মসজিদ বলিয়া মােটেই স্বীকৃতি দান করেন নাই সেইহেতু আমরা দেখিতে পাই-কোনও গির্জা বা উপাসনালয় তৈরি করা হয় নাই। যদি এইরূপ কিছু তৈরি করা হইত তাহা হইলে সাকার মসজিদকে অর্থাৎ এবাদত খানারূপে মসজিদ গৃহকে কোরআনে ‘মসজিদ বলিয়া স্বীকৃতি দিয়াছেন বলা যাইত; এবং সেই ক্ষেত্রে আসহাবে কাহাফের ঘটনাটির স্মৃতি চিহ্ন স্বরূপ একটি মসজিদ গৃহ (অর্থাৎ গির্জা—যেহেতু তখন খ্রিস্টধর্মের আমল ছিল) উল্লিখিত সিদ্ধান্ত অনুসারে আজও জগতের বুকে বিদ্যমান থাকিত। কিন্তু তেমন কিছুই নাই এবং কখনও ছিল বলিয়া প্রমাণও নাই।।
এই ঘটনার জাহেরি একটি স্মৃতিচিহ্ন তৈরি করিলে উহার উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হয় না। একমাত্র নিজ জীবনে মসজিদকে ‘ধরিয়া লওয়ার চেষ্টায় থাকিয়াই এই আসহাবে কাহাফের উপযুক্ত স্মৃতিরক্ষা করা যায়। স্থুল বস্তু-নির্মিত স্মৃতির কোনও মর্যাদা আল্লাহর নিকট নাই। এই উপাখ্যানের আসল শিক্ষাগ্রহণ করিয়া
আসহাবুল কাহাফের জীবনাদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া উহার উপর মসজিদকে গ্রহণ করা যাইতে পারে—অর্থাৎ নিজ নিজ জীবনে আল্লাহর মসজিদকে গ্রহণ করিয়া লওয়াই ইহার যােগ্য স্মৃতিরক্ষা।।
কাহাফ শুধু পর্বত গুহা নহে, কাহাফ ‘আল্লাহর মসজিদ’। কাহাফের রহস্যলােকে প্রবেশ না করিলে ‘দুনিয়া’ হইতে আশ্রয় লইয়া মসজিদে প্রবেশ করা সম্ভব হয় না।
সুতরাং, কাহাফ’ মসজিদেরই নামান্তর।
সুরা কাহাফের ১৬ সংখ্যক বাক্যে সকল মানুষকে সাধারণভাবে বলিতেছেন,
“যখন তােমরাও তাহাদিগকে
(অর্থাৎ অংশীবাদী সমাজকে) এবং আল্লাহ ব্যতীত তাহারা যাহাদের দাসত্ব
(প্রবৃত্তি ও বস্তুবাদের দাসত্ব) করে উহাদিগকে পরিত্যাগ করিবে তখন তােমরা কাহাফের দিকে গমন কর
(বা কাহাফের অশ্রয়গ্রহণ কর ) তবেই তােমাদের রব তােমাদের প্রতি তাহার রহমত প্রসারিত করিয়া দিবেন এবং তােমাদের জন্য তােমাদের কার্যসমূহকে জীবন্ত করিয়া দিবেন এবং তাহা সহজসাধ্য করিয়া দিবেন।।
প্রকৃতপক্ষে ‘কাহাফ’ পর্বত গুহাই নহে, ‘কাহাফ’ শব্দটি শুধু একটি নামকরণ মাত্র। উহা আল্লাহর রহমতের গুহা বা আবরণ। সেইখানে প্রবেশ করিতে পারিলে দুনিয়ার সকল আবিলতা ও শিরক হইতে মুক্তিলাভ করা যায়। মানুষ নিজ হইতে সেইখানে প্রবেশ করিতে পারে না। প্রবেশের চেষ্টা করিলে আল্লাহ তাহার নিজ রহমত ও দয়া তাহার জন্য বৃদ্ধি করিয়া উহাতে প্রবেশ সহজসাধ্য করিয়া দিবেন। কাহাফে
প্রবেশকারীর সমস্ত কথা ও কর্মই জীবন্ত, যেহেতু প্রবেশকারী সত্যের সঙ্গে সংযুক্ত হন। কাহাফের বাহিরে মানব জীবন অসত্য ও শিরকে ভরপুর। অসত্য ক্ষণস্থায়ী ও ধ্বংসাত্বক। কাহাফে প্রবেশ করিবার পর
সাংসারিক সকল কর্মই সত্যমণ্ডিত ও জ্যান্ত হইয়া উঠে এবং সর্বকর্মের মধ্যেও রবের সঙ্গে সংযােগ রক্ষা করা তিনিই সহজসাধ্য করিয়া তুলেন।।
যখন কোনও ব্যক্তির রহস্যলােকে প্রবেশ-আকাক্ষা ও অগ্ৰহ আল্লাহ, রসুল ও মােমিনদের পছন্দ মত হয় কেবল তখনই তাহাকে রহস্যলােকে গ্রহণ করা হয়। রহস্যলােকে গ্রহণ করিবার উদ্দেশ্যে সংসারের সকল মানুষের আমলের প্রতি তাহারা আগ্রহের সহিত তাকাইয়া আছেন।
‘কাহাফ’ অর্থে কোরআনে পর্বত গুহা’ মােটেই বুঝায় কিনা তাহা জোর দিয়া বলা কঠিন। কাহাফের স্বরূপ এমনই রহস্যময় ও সুন্দর যে, উহাকে নিছক পর্বত গুহা ধরিয়া লইলে সুরা কাহাফের মধ্যে আসহাবুল কাহাফ’ উপাখ্যানটির অর্থের কোনও মিল পাওয়া যাইবে না। আবার ‘কাহাফ’ অর্থ যে পবর্ত গুহা তাহাও একেবারে ছাড়িয়া দেওয়া যায় না। ঠিক যেমন কোরান-মসজিদ। না উহা কোনও গৃহ, না উহা গৃহে আবদ্ধ; যদিও মসজিদ বলিতে প্রথমতঃ মসজিদ গৃহের ধারণাই মনে আসিয়া থাকে। ঠিক সেইরূপ ‘কাহাফ’ বলিতে পর্বত গুহা মােটেই বুঝায় নাই। অথচ শাব্দিক অর্থ হিসাবে উহাকে ‘পর্বত গুহা” বলিয়াই প্রথমতঃ ধরিয়া লইতে হয়। যদি কাহফ অর্থে শুধু পর্বত গুহাই বুঝাইত তাহা হইলে সংসারের অন্যায়কারী এবং অন্যায়কর্ম হইতে আশ্রয় লইবার জন্য তথা দুনিয়া হইতে উদ্ধারলাভের জন্য আল্লাহ তায়’লা সবাইকে কাহাফে প্রবেশ করিতে কেন আদেশ করিতেছেন ?
সুতরাং, ‘কাহাফ’ মসজিদেরই অপর একটি রূপক নাম মাত্র।।
যদি কোনও মানুষ আল্লাহর রহমতে মসজিদের মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া যাইতে পারেন তাহা হইলে যে সকল অবস্থায় সেই মানুষ বাস করেন তাহার বর্ণনা দেওয়া প্রয়ােজন। কাহাফে প্রবেশ করা আর মসজিদের অধিবাসী হওয়া প্রায় অনুরূপ। মসজিদে প্রবেশকারী লােকেরা যে সকল অবস্থার অধীন হইয়া থাকেন আল কাহাফে
প্রবেশকারীর অবস্থা তাহাদের অন্যতম। আল কাহাফ হইতে বাহির হইয়া আসিয়া যদি কোনও মানুষ পুনরায় সংসারধর্ম পালন করা সত্ত্বেও সেই সংযােগ অক্ষুন্ন রাখতে পারেন তবেই তিনি সত্যিকাররূপে মসজিদের অধিবাসী বলিয়া পরিগণিত হইতে পারেন। তখন সেই ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে বাস করেন। মন হইতে
সর্ব প্রকার শিরক তখন দূর হইয়া যায়। আল্লাহ তখন সারা সৃষ্টির রবৰূপে অখণ্ডভাবে দৃষ্টিপথে আবির্ভূত
হইয়া সেই ব্যক্তির সমগ্র দৃষ্টি ও মনকে অভিভূত এবং নিবদ্ধ করিয়া রাখেন। তৌহিদ ভিত্তিক জীবন এইরূপই হইয়া থাকে। মসজিদে অবস্থানকারী ব্যক্তিগণের নানা রকম অলৌকিক অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং কুরআন সাধনার একাগ্রতা ও গভীরতা অনুসারে তাহাদের স্তরভেদ হইয়া থাকে। চারিটি উপাখ্যানকে অবলম্বন করিয়া কুরআন সাধকদের বৈশিষ্ট্য চারটি আধ্যাত্মিক পর্যায়ের স্বরূপ সুরা আল কাহাফে অঙ্কিত হইয়াছে যাহার প্রথম পর্যায় হইল আল কাহাফে আশ্রয় লওয়া এবং শেষ চরম পর্যায় হইল ‘জুলক্বারনাইন’-এর আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতার অবস্থা। সেইখানে প্রকাশ্য ও অপকাশ্য মিলিতভাবে পূর্ণতালাভ করিয়াছে।।