(১ম পর্ব)
০১. ভূমিকা: মহাগ্রন্থে বহুবার জিজ্ঞেস করা হয়েছে- আফালা তা’কিলুনা (أَفَلَا تَعْقِلُونَ ২:৪৪)? শব্দটি এসেছে আ’কল থেকে। আক’ল অর্থাৎ মেধার চর্চা, যুক্তিবোধ, শানিত বিবেকবোধ, যৌক্তিক চিন্তার চেষ্টা করা। দু-একবার নয়, বরং ৪৯বার প্রশ্ন করা হয়েছে, জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তাড়না ও প্রেরণা দেওয়া হয়েছে!
বলা হয়েছে- আফালা তাফাক্কারুন (أَفَلَا تَتَفَكَّرُونَ ৬:৫০)? আরও ১৭বার এই প্রশ্নটিও করা হয়েছে! মহান রবের আয়াত নিয়ে যেন ‘ইয়া-তা-ফাক্কারুনা’/ তারা গভীর গবেষণা করতে পারে- সেক্ষেত্রে ভীষণ জোর দেওয়া হয়েছে (লায়াল্লাকুম ইয়াতাফাক্কারুন), প্রশ্ন করা হয়েছে (আফালা ইয়াতাফাক্কারুন?), বিবেক জাগ্রত করার চেষ্টা করা হয়েছে (লি কওমি ইয়াতাফাক্কারুন)!
এমনকি- আফালা তাদাব্বারুন (أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ৪:৮২)? তাদাব্বুর অর্থ চিন্তা-ভাবনা-গবেষণা করা। অন্তত চারবার এই প্রশ্ন করা হয়েছে, উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। কেন মহাগ্রন্থ নিয়ে তোমরা গভীর গবেষণা করো না!
এ ছাড়া, অন্তত ৩৫বার মহাগ্রন্থে এসেছে ‘আলাম তারা’(ألم تر) তুমি কি দেখো না/ বোঝো না/ উপলব্ধি করো না? এই প্রশ্ন আরও দুই শতাধিকবার এসেছে বিভিন্ন চিহ্ন/আয়াত/বিষয়াদি দেখা এবং এ সম্পর্কিত বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে!
হয়তো আরো আছে! আমরা শুধু মহান আল্লাহর উল্লেখিত নির্দেশ, প্রশ্ন, উৎসাহ-প্রেরণা-তাড়না ও মানুষের মন-মগজ-বিবেক জাগ্রত করার এই দাবিটার কথাই বলছি, যা এসেছে অন্তত ১০৫বার ! শতাধিকবার ! মহান রবের এই নির্দেশনা আমাদের কাছে কি ‘নফল/মুস্তাহাব/সুন্নত’ক্যাটাগরির বিষয়?
আফালা তা’কিলুন (أَفَلَا تَعْقِلُونَ)? চিন্তা করে নিজেকেই উত্তর দিন!
মনে রাখবেন, অনেক কান্নাকাটি করে মহান রবের কাছে যে প্রার্থনা করলেন: ইহদিনাস সিরাত্বল মুস্তাকিম…. তার জবাবে মহান রবের প্রথম কথাটাই হলো: আল-কিতাবই হলো সন্দেহাতীত হুদা বা পথ-নির্দেশনা এবং তারাই পথ পাবে যারা সজাগ-সচেতন মানুষ (আল-মুত্তাকি)।
এবার ভাবুন, আপনি কি একজন সজাগ-সচেতন মানুষ? আপনি কি মুত্তাকি?
আপনি কি আকাশে মেঘ দেখলে টের পান যে- আজ বৃষ্টি হতে পারে! আপনি কি ধোঁয়া দেখে বুঝতে পারেন যে- আগুন লেগেছে কোথাও? আপনি কি চিৎকার শুনে বোঝেন যে- ঝগড়া বাঁধিয়েছে কেউ! আপনি কি প্রিয়তমের মুখ দেখে টের পান যে- গণ্ডগোল হয়েছে কিছু! আপনি কি লোকের হাবভাব দেখে ঠাহর করতে পারেন যে- আগাগোড়া প্রতারক/মিথ্যাবাদী সেই লোক!
অথবা, কারও বিনয়-সততা-ভদ্রতা দেখে বোঝেন কি যে- সে নিরেট ভালো মানুষ; তাকে গুরুত্ব দেওয়া যায় অথবা, ‘বলির পাঠা’বানানো যায়! কারও সাদাসিদা সরল কথা শুনে তাকে লুটে-পুটে শেষ করে দেওয়া যায়- তাও কি বুঝতে পারেন?
আপনি কি শিশুর কান্না শুনে বোঝেন যে- কি ভীষণ কষ্টে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে তার ছোট্ট অন্তর! কোটিপতির মখমলে মোড়ানো শিশু- আর পথের নোংরা ধুলায় অবহেলায় গড়াগড়ি খাওয়া শিশুটির হৃদয়-মনের দহনে কোনো ফারাক নেই(!)—সে কথা কি মন-মগজে ধরে আপনার?
ফুলের বাহারি রং-রূপ দেখে বোঝেন কি—সৃষ্টি কত বিস্ময়কর! পাখির কিচির-মিচির শুনে বুঝতে পারেন কি- তাদেরও আছে বেঁচে থাকার অধিকার! মাছের আঁশ দেখে কি হঠাৎ মনে হয় যে- স্বচ্ছ একটুকরা ‘দুর্গন্ধ আঁশও’ পয়দা করতে পারেনা মানবজাতি!
মুখে স্বীকার না-করলেও যদি বোঝেন যে, কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা; অন্ধভাবে স্বৈরাচারের জন্য স্লোগান তুলেও যদি মনের কোনে ফিস ফিস করে কেউ- ‘ওটা ঠিক নয়, ওটা অন্যায়, মিথ্যাচার’—তবেই আপনি মানুষ! যদি হঠাৎ বুঝতে পারেন, সেদিন চলার পথে ‘ব্যাক্কল বিড়ালটাকে’লাথি মারা ঠিক হয়নি(!), ‘অপদার্থ-মূর্খ রিক্সাওয়ালাকে’ থাপ্পড় মারা ছিল আপনারই মূর্খতা(!); ‘ইতর-ছোটলোকটার’ বাপ-মা তুলে গালি দেওয়া- আপনারই জীবনভর অর্জনের ব্যর্থতা(!), তাহলেই ধরা যাবে—হয়তো আপনি এখনও মানুষ!
অধঃপতনের চূড়ান্ত ধাপে পা দিয়েও যদি লেশমাত্র সত্য অবশিষ্ট থাকে, অন্তরজ্বালায় ছটফট করে ওঠেন এক লহমা, ক্ষণিকের জন্য হলেও আপনি হঠাৎ ‘বুঝে ওঠেন’ কিছু একটা—তাহলেই আপনি মুত্তাকি হবার প্রথম শর্ত পূরণ করেছেন।
অভিনন্দন! মহাগ্রন্থ আল-কুর’আন আপনাকেই সঠিক পথ দেখাবে! আপনিই জানবেন- সিয়াম কাকে বলে। কুতিবা অর্থ কি?
০২.কুতিবা (كُتِبَ): ‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর’ মতো ‘কিতাব-জুড়ে সিয়াম খোঁজা’ শুরু করেছি আমরা। সে ধারাবাহিকতায় ‘সিয়াম’ (الصِّيَامُ) সম্পর্কে জানার ও বোঝার চেষ্টা করবো।
তবে সিয়াম সম্পর্কে জানার আগে কুতিবা (كُتِبَ) সম্পর্কে জানা জরুরি। কারণ, আস-সিয়াম তো কুতিবা হয়েছে! তাই কুতিবা সম্পর্কে না জানলে- সিয়াম সম্পর্কেও জানা-বোঝা যাবে না।
যেমন ধরুন, ‘ভেজিটেবল কুক’ করতে বলা হলো। যার উদ্দেশ্য খেয়েদেয়ে স্বাস্থ্য ভালো রাখা। তবে আপনাকে জানানো হলো কুক/ cook অর্থ- রোদে শুকানো(!); আর ভজিটেবল/ vegetable অর্থ জামাকাপড়(!) (অভিধানেও তা লেখা হলো)। এবার অবধারিত ভাবে আপনি ধরে নেবেন ‘ভেজিটেবল কুক করা’ মানে জামাকাপড় ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করে রোদে শুকিয়ে গায়ে দেওয়া। যাতে শরীর-মন উন্নত হয়। তাইনা ?
তাই, সিয়াম বোঝার জন্যই আমরা কুতিবা (كُتِبَ) শব্দের অর্থ কুর’আনের দলিল সহ বুঝবো। অভিধান ও প্রচলিত অনুবাদ আমাদের জন্য রেফারেন্স মাত্র; কিন্তু পথনির্দেশক হলো মহাগ্রন্থ। চলুন শরু করা যাক।
মহাগ্রন্থে ‘সিয়াম (الصِّيَامُ)’ সম্পর্কে মহান আল্লাহর প্রথম বক্তব্যটি হলো- ‘কুতিবা আলাইকুম আস-সিয়াম’ (كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ) যার প্রচলিত অনুবাদ হলো ‘তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে’! কী বিস্ময়কর মিথ্যাচার ও জালিয়াতি অনুবাদ!
— কেন জালিয়াতি অনুবাদ?
কুতিবা: ফরজ করা হয়েছে; আলাই-কুম: তোমাদের ওপর; সিয়াম: রোজা !!!
শুধুমাত্র, আলাই-কুম বা ‘তোমাদের ওপর’ এই অংশের অনুবাদটাই ঠিক আছে। বাকি দু’টি শব্দ ইচ্ছা করে পরিবর্তন করা হয়েছে।
— বাকি ২টা শব্দ ঠিক নেই! এ দাবির প্রমাণ কি??
— প্রমাণ হলো খোদ মহাগ্রন্থ, অর্থাৎ আল্লাহর কথা!
যেমন, রুব্বুল আলামিন নিজেই বলেছেন- আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরজ বা ফারিদাতুম মিনাল্লাহ (فَرِيْضَةً مِّنَ اللّٰهِ)। দেখা যাচ্ছে, ফরজ (فرض) শব্দটি মহান আল্লাহ জানেন এবং যেখানে বলা প্রয়োজন সেখানেই তিনি বলেছেন! নাকি ভিন্ন কিছু ভাবছেন ?!? (ফরজ/নির্ধারণ দেখুন এখানে ৪:৭,১১; ৯:৬০; ২৪:১; ২৮:৮৫, ৩৩:৩৮,৫০)। কিন্তু সিয়ামের সঙ্গে তিনি ফারদ/ফরজ বলেন নি(!) বরং, কুতিবা বলেছেন। একটা কুর’আনিক আরবি শব্দ ‘কুতিবা’ (كُتِبَ) অর্থ আরেকটা কুর’আনিক আরবি শব্দ ‘ফরজ’ (فرض) হতে পারে? ‘আম’ অর্থ কখনও ‘কলা’ হয়? হতে পারে? অবশ্যই না!
ঠিক তেমনি- সিয়াম অর্থ রোজা, উপবাস, সকাল সন্ধ্যা না খেয়ে থাকা লেখা হয়েছে। যা জোর করে আরোপিত অনুবাদ। সিয়ামের তদন্তে যাবার আগে কুতিবা (كُتِبَ) জেনে নেওয়া যাক।
কুতিবা (كُتِبَ) মানে কি?
যেহেতু সিয়াম কুতিবা (করা হয়েছে), সেহেতু কুতিবা না বুঝলে কোনোভাবেই ‘সিয়াম’ জানা, বোঝা বা উপলব্ধি করা যাবে না।
কুতিবা (ধাতু: কাফ-তা-বা) শব্দটি মহাগ্রন্থে এসেছে মাত্র ১১বার। এই ১১টা আয়াত পড়লে ও বুঝলেই আপনি জানতে পারবেন ‘কুতিবা’ (كُتِبَ) দিয়ে কি বোঝানো হয়েছে। আর এই ১১বারের মধ্যে সাতবারই ২নং সুরাতে! (২:১৭৮, ১৮০, ১৮৩, ২১৬, ২৪৬; ৩:১৫৪; ৪:৭৭, ১২৭; ৯:১২০, ১২১ এবং ২২:৪)
সবগুলো আয়াত বিশ্লেষণ করা সময়-সাপেক্ষ কাজ। তাই দ্রুত বোঝার সুবিধার্থে আমরা ২:২৪৬ এবং ৩:১৫৪ বাক্যটি দেখবো।
প্রচলিত অনুবাদ ৩:১৫৪ অতঃপর কষ্টের পর আল্লাহ তোমাদের প্রতি শান্তি-তন্দ্রা প্রেরণ করলেন, যা তোমাদের একদলকে আচ্ছন্ন করল এবং অন্যদল মূর্খের মতো আল্লাহর প্রতি কুধারণা পোষণ করতঃ নিজেরাই নিজেদের জীবনকে উদ্বেগাকুল করে বলল, কাজ-কর্মের ব্যাপারে (সিদ্ধান্ত গ্রহণের) আমাদের কিছু মাত্র অধিকার আছে কি? বল, ‘সমস্তই আল্লাহর নিরঙ্কুশ অধিকার’। তারা এমন সব কথা অন্তরে পোষণ করে- যা তোমার কাছে প্রকাশ করে না। তারা বলে, ‘যদি মতামত প্রদানের অধিকার আমাদের কিছু মাত্রও থাকত, তাহলে আমরা এ স্থলে নিহত হতাম না’। বলে দাও, ‘যদি তোমরা তোমাদের ঘরেও থাকতে, তথাপি যাদের মৃত্যু লেখা ছিল, তারা তাদের এ মৃত্যুর পানে বের হয়ে পড়ত’; এবং এজন্যও যে আল্লাহ তোমাদের অন্তরের ভেতরের বিষয়গুলো পরীক্ষা করেন এবং তোমাদের অন্তরস্থ বিষয় গুলোকে পরিষ্কার করেন, বস্তুতঃ আল্লাহ সকলের অন্তরের কথা সম্পর্কে বিশেষ ভাবে অবহিত।
৩:১৫৪ এর শেষ দিকে বলা হলো-
…যদি আমাদের কোনো কিছুর বিষয়ে এখতিয়ার থাকতো- আমরা (আমাদের লোকেরা) এখানে নিহত হতাম না (!)
বলে দাও- যদি তোমরা তোমাদের ঘরের মধ্যেও থাকতে, অবশ্যই বের হতো তারা- যাদের ওপর নিহত হওয়ার/মারা যাবার ‘কুতিবা হয়েছে’ (আল-ক্বতলু কুতিবা) তাদের নিহত হবার স্থানের দিকে…
এখানে কুতিবা অর্থ- ‘লিখে দেওয়া হয়েছে’ ধরলে, প্রমাণ হয় যে, মহান আল্লাহ মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেন ও তকদির লিখে দেন ! অর্থাৎ, মানুষের চেষ্টা-কর্ম-চিন্তা-উদ্যোগের কোনো মূল্যই নাই! এই অর্থ বিশ্বাস করলে সম্পূর্ণ একটি মহাগ্রন্থ নাযিল করা, মানুষের চিন্তা বিবেক জাগ্রত করে সঠিক পথে চলতে বলা, অন্যায়-অত্যাচার-মিথ্যাচার মোকাবিলা করতে বলা, সর্বশক্তি দিয়ে ন্যায় ইনসাফ কায়েম করতে বলা, সালাত-যাকাতের জন্য বলা এবং সৎকর্মশীলদের ভালো কাজ করতে বলা— সবই অর্থহীন হয়ে যায়। নিশ্চয়ই তা বুঝতে পারছেন!
অথচ বাস্তবতা হলো, মহান আল্লাহ মানুষকে কোনো কাজের জন্যই বাধ্য করেন না, এজন্যই মানুষের স্বেচ্ছায় করা ভালো বা মন্দ কাজের জন্য পুরস্কার বা শাস্তি দেবেন তিনি। স্বাধীনতার এই ক্ষমতা বা শক্তি (ইবাদত) দেওয়া হয়েছে মানুষ ও জিনকে। এই দুই সৃষ্টি- স্বাধীন শক্তির কারণেই কর্মের প্রতিদান পাবে। আর কোনো কিছুই স্বাধীন নয়। তাদের/সেসবের কোনো প্রতিদান নেই। এ বিষয়টি বুঝতে পারেন আপনি? চিন্তা শক্তি-যুক্তিবোধ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করুন।
কুতিবা (كُتِبَ) অর্থ- ‘লিখে দেওয়া হয়েছে(!)’ এমন মিথ্যাচার করে গোটা পৃথিবীকে মহাসত্য থেকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে! আল্লাহর নাম নিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দলে দলে লোক মুশরিকে পরিণত হয়ে অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেছে!
অধিকাংশ মানুষ আল্লাহতে বিশ্বাস করে, কিন্তু সেই সঙ্গে শিরকও করে। {১২:১০৬}
কিতাবধারীদের মধ্যে যারা কুফুরি করে তারা- আর মুশরিকরা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে। এরাই সৃষ্টির অধম। {৯৮:৬}
আর তাদের বেশিরভাগ অনুমান/ধারণা (ظَنًّاۗ) ছাড়া অনুসরণ করে (يَتَّبِعُ) না; নিশ্চয়ই সত্যের (ٱلْحَقِّ) ক্ষেত্রে অনুমান/ধারণা (ٱلظَّنَّ) কোনো কাজ করে না…{১০:৩৬}
যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার অনুসরণ করো না…{১৭:৩৬}
যারা মনোযোগ দিয়ে কথা শোনে এবং তাতে যা উত্তম তা গ্রহণ করে। এরাই সেসব লোক, যাদের আল্লাহ্ হিদায়াত করেছেন এবং তারাই বুদ্ধিমান লোক। {৩৯:১৮}
‘কুতিবা’ অর্থ কি?
কুতিবা (كُتِبَ) অর্থ সেটাই, যা ৩:১৫৪ আয়াতে বসবে এবং অন্য ১০টি আয়াতেও যথাযথ অর্থপূর্ণ বক্তব্য দেবে। আর তা হলো- “জোরালো নির্দেশনা/তাড়না/প্রেরণা/উৎসাহ দেওয়া’; এবং ওই কথাটির অপেক্ষাকৃত সঠিক অনুবাদ হলো-
…যদি আমাদের কোনো কিছুর বিষয়ে এখতিয়ার থাকতো- আমরা এখানে নিহত হতাম না;
বলে দাও- যদি তোমরা তোমাদের ঘরের মধ্যেও থাকতে, অবশ্যই বের হয়ে যেত তাদের নিহত হবার স্থানে- যাদের ওপর নিহত হওয়ার/মৃত্যুকে বরণ করার ‘জোরালো প্রেরণা উৎসাহ দেওয়া হয়েছে’ (আল-ক্বতলু কুতিবা)…
অর্থাৎ, কুতিবা শব্দটির ব্যাখ্যামূলক অর্থ হলো- জোরালো তাড়না-প্রেরণা-উৎসাহ-নির্দেশনা দেওয়া।
এই শক্তিশালী তাড়না-প্রেরণা-নির্দেশনার মাত্রা মহান আল্লাহই ঠিক করে দেন বলেই বোঝা যাচ্ছে। কারণ, এই প্রেরণা একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকলে- মানুষের নফস তা অস্বীকারও করতে পারে! এবং সে কথাও বলা হয়েছে ২:২৪৬ এর শেষাংশে (তবে, তীব্র মাত্রা হলে মানুষ ৩:১৫৪ এর মতো আত্মসমর্পণ করে- মৃত্যুর পানে ছুটে যায়):
…..তারপর যখন তাদের উপর সংগ্রাম/লড়াই/যুদ্ধ কুতিবা হলো (তাদের হৃদয়ে লড়াইয়ের জন্য শক্তিশালী নির্দেশনা/প্রেরণা দেওয়া হলো), তখন তাদের অল্প কিছু লোক ছাড়া বাকি সবাই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলো; আল্লাহ যালিমদের অবস্থা বিশেষভাবে অবহিত।
ঠিক এভাবেই ৩:১৫৪ আয়াতে মানুষের অন্তর-মনের বিষয়েই কথা হচ্ছে। যা গোপন করা হয়, যা প্রকাশ করে মানুষ। শেষ দিকে বলা হয়েছে- “এর কারণ হলো, আল্লাহ তোমাদের মনে যা আছে তা পরীক্ষা করতে চান এবং তোমাদের সংশোধন ও পরিশুদ্ধ করতে চান। আল্লাহ অন্তরের খবর বিশেষভাবে জানেন।
খেয়াল রাখুন- মানবদেহের মধ্যে যে নফস দেওয়া হয়েছে- তাই মূলত আমি/আপনি। এই প্রকৃত ‘আমি’ কি সিদ্ধান্ত নেয়- তার পরীক্ষাগার এই বাস্তব পৃথিবী। পাশাপাশি, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে- সেই আমি/আপনি/নফস পরিশুদ্ধ হয়। নয়তো সে জালিম হয়।
৩:১৫৪ এর শেষ কথাটা হলো “বলে দাও- যদি তোমরা তোমাদের ঘরের মধ্যেও থাকতে, যাদের ওপর নিহত হওয়ার/মৃত্যুকে বরণ করার “শক্তিশালী নির্দেশনা/প্রেরণা দেওয়া হয়েছে”- অবশ্যই তারা বের হয়ে যেত- তাদের নিহত হবার স্থানের দিকে…”
এবার কিতাব দিয়ে আরেকবার যাচাই করুন। দেখুন বাকি ৮টি কুতিবা।
২:১৭৮এ কুতিবা আলাইকুম কিসাস..। অর্থাৎ, হত্যার বদলে হত্যার ‘জোরালো নির্দেশনা-প্রেরণা দেওয়া হয়েছে’। গভীর জঙ্গলেও হত্যার প্রতিশোধের উন্মত্ত তাড়নায় মেতে ওঠে শিক্ষা-দীক্ষা বর্জিত মানুষগুলো!
২:১৮০তে কুতিবা আলাইকুম…আল-ওসিয়াত। উন্নত দেশগুলো দেখুন। সচেতন মানুষগুলো মৃত্যুর আগেই তাদের সম্পদ ‘উইল/ওসিয়াত’ করে যায় নিকটজন ও অভাবীদের জন্য। এই প্রেরণা তাদেরকেও দেওয়া হয়েছে। বাংলার দানবীর হাজী মুহাম্মদ মহসিনের নাম কে না জানে! মৃত্যুর ৬ বছর আগে ১৮০৬ সালে তিনি পুরো সম্পত্তি মানবকল্যাণে ওয়াকফ করে যান।
২:২১৬তে কুতিবা আলাইকুম আল-কিতালু। যদিও বেশিরভাগ মানুষ লড়াই-সংঘাত-সংঘর্ষ-যুদ্ধ অপছন্দ করে। কিন্তু বাস্তব প্রয়োজনে- সেই প্রাচীন গুহা-গোত্রের যুগ থেকে আধুনিক রাষ্ট্র পর্যন্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে অনিবার্যভাবে যুদ্ধ-সংগ্রাম-লড়াইয়ে জড়ায় মানুষ। যুদ্ধের নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে তরুণ-যুব সমাজ। সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার মহান এই মৃত্যুক্ষুধা- কোথা থেকে পেল শান্তিপ্রিয় মানুষ!
৪:৭৭এও আল-কিতাল সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং মানুষের মনস্তাত্ত্বিক চরিত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
৪:১২৭এ অর্থ-লোভে এতিমদের মেয়েদের বিয়ে করে তাদের সম্পদ থেকে বঞ্চিত না-করার বিষয়টি মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই নির্দেশনা ও প্রেরণা কথা আল-কিতাবেও উল্লেখ করা হয়েছে যা কিতাব-ধারীরা পড়ে ও জানে বলেই উল্লেখ করা হয়েছে! এটাই কুতিবা। মানুষকে যথাযথ তথ্য দেওয়া।
৯:১২০ একটি বড় আয়াত। কুতিবা অংশটুকুর অনুবাদের ভুল সংশোধন করলে যা দাঁড়ায় তা হলো: সেটা এজন্য যে, আল্লাহর পথে তাদের তৃষ্ণা, ক্লান্তি ও ক্ষুধার কষ্ট হয় এবং তাদের পদক্ষেপে কাফিরদের ক্রোধ হয় এবং শত্রুদের ক্ষতি হয়- শুধুমাত্র এজন্য যে তাদের জোরালো তাড়না-উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দেওয়া হয়েছে সৎকর্মে (আমলে সলিহা)…।
২২:৩,৪ থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ সম্পর্কে মূর্খ ও অজ্ঞের মতো যে কথাবার্তা বলে, সেও জোরালো উৎসাহ-তাড়না-প্রেরণা পাবে। কি সেই প্রেরণা? তা হলো, যেসব মানুষ তাদেরকে অভিভাবক ও বন্ধু বানাবে, মূর্খ ও অজ্ঞগুলো তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে জ্বলন্ত শাস্তির শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাবে।
তাহলে, কুতিবা শব্দটির প্রকৃত ব্যাখ্যামূলক অর্থ হলো: শক্তিশালী তাড়না-প্রেরণা-নির্দেশনা দেওয়া। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে জোরালো প্রেরণা!
এখনও পৃথিবীতে উপরোক্ত বিষয়ে মানুষকে কুতিবা (জোরালো তাড়না-প্রেরণা) দেওয়া হচ্ছে! হরহামেশা সেই কুতিবা হচ্ছে। কবি নজরুলের কবিতা কিঞ্চিত পরিবর্তন করে বলা যায়-
কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে
কিসের জোরে করছে তারা বরণ মরণ-যন্ত্রণাকে।
সহস্র বছর ধরে লক্ষ কোটি বনি-আদম অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকেও মাথা পেতে নেয়। কেন? কে দেয় সে অন্যায় মোকাবিলার প্রেরণা….? কে দেয় মৃত্যুকে বরণ করার তাড়না?
সেটাই হলো- কুতিবা (كُتِبَ) আলাইহিম- তাদের ওপর কুতিবা।
আর, হত্যার শাস্তি হত্যা (কিসাস), লড়াই-সংগ্রাম-যুদ্ধ (ক্বিতাল), ওসিয়াত (উইল) এর মতোই একটি বিষয় হলো “সিয়াম”! যা স্থান-কাল-পাত্রভেদে জগতের সব আমানুর ওপর কুতিবা হয়েছে। আপনি যদি আমানু হন, অর্থাৎ- বিশ্বাসী, সৎ, ভালো ও শান্তিপ্রিয় মানুষ হন তাহলে আপনিও জানেন “আস-সিয়াম” কি জিনিস ! কারণ, সিয়ামের বিষয়ে আপনাকেই জোরালো তাড়না-প্রেরণা-উৎসাহ-উদ্দীপনা (কুতিবা) দেওয়া হয়েছে। আপনার মন-মনন, বিবেক সিয়ামের বিষয়ে নির্দেশিত।
০৩. সিয়াম (الصِّيَامُ): আগের লেখাগুলো থেকে আমরা জানতে পারলাম- ‘কুতিবা আলাইকুমুস সিয়াম’ (الصِّيَامُ) মোটামুটি কি বোঝানো হয়েছে? যদিও আস সিয়ামু (২:১৮৩ الصِّيَامُ) শব্দের পাঠোদ্ধার এখনও করা হয়নি। তবে বোঝা গেল যে, কুতিবা শব্দের অর্থ হলো- ‘জোরালো নির্দেশনা/তাড়না/প্রেরণা/উৎসাহ দেওয়া’ অথবা জোরালো প্রেরণা দেওয়া।
এবং এটাও বোঝা গেল যে-
২:১৭৮ কুতিবা আলাইকুম কিসাস.. ২:১৮০ কুতিবা আলাইকুম…আল-ওসিয়াত.. ২:২১৬ কুতিবা আলাইকুম আল-ক্বিতাল..
সবক্ষেত্রেই কিসাস (হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড), ওসিয়াত (মৃত্যুর আগে সম্পদ লিখে দেওয়া) ও ক্বিতাল (যুদ্ধ-সংগ্রাম-লড়াই) হলো শর্তযুক্ত (conditional) বিষয়। অর্থাৎ, যখন সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পরিস্থিতি তৈরি হবে, তখন ক্বিতাল, ওসিয়াত ও কিসাস কার্যকর হবে।
এই ধারাবাহিকতায় আছে কুতিবা আলাইকুম আস-সিয়াম (২:১৮৩)। তাহলে, সিয়ামও কার্যকর হবে, যদি সিয়ামের শর্ত বা পরিবেশ তৈরি হয়। অতীতে কি এমনটা হয়েছিল? যেহেতু ২:১৮৩ আয়াতেই বলা আছে- কামা কুতিবা আলাল্লাযিনা মিন ক্ববলিকুম (كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ) যেমন ‘জোরালো প্রেরণা ছিল’ তোমাদের আগেও..।
সম্পূর্ণ আয়াতটি আরও একবার দেখুন। যা আনুমানিক ১৪৫০ বছর আগে নাযিল হয়েছিল।
২:১৮৩ ওহে যারা ঈমান এনেছ, তোমাদের উপর আস-সিয়াম (الصِّيَامُ) জোরালো প্রেরণা (كُتِبَ-কুতিবা) করা হয়েছে, যেমন জোরালো প্রেরণা (كُتِبَ-কুতিবা) হয়েছিল তোমাদের আগে (عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ)- যাতে তোমরা সজাগ-সচেতন হও (لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ)।
এই আয়াতটিও আমাদের তুলনায় দেড় হাজার বছর অতীতে নাযিল হয় এবং আল্লাহর রসুল ও সমসাময়িক মানুষদের জন্যও একটি শর্ত যুক্ত করা হয়!
২:১৮৫ রমাদ্বানের শাহরা (شَهْرُ رَمَضَانَ)- তাতে নাযিল হয়েছিল আল-কুর’আন (الَّذِيْٓ اُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْاٰنُ)……….অতএব তোমাদের মধ্যে যে-কেউ সেই সুনির্দিষ্ট মাসটি প্রত্যক্ষ করবে (فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ), অতঃপর সে সিয়াম করুক (فَلْيَصُمْهُ);
নিশ্চয়ই শর্তটি দেখা যায়! দেড় হাজার বছর আগের লোকদের বলা হয়েছিল, মহাগ্রন্থ আল-কুর’আন নাযিলের ‘সেই সুনির্দিষ্ট মাস’ বা আশ-শাহরা (الشَّهْرَ) যে প্রত্যক্ষ করবে- সে যেন ‘সিয়াম’ করে! (فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ)! যখন কোনো শব্দ বা বিষয়ের সঙ্গে নির্দিষ্ট নির্দেশক টি/টা The / আরবি আল (ال) যুক্ত হয়, তখন শুধু সেটাই বোঝায়। এ কারণে যখন বলা হয়- আল+শাহরা (شَّهْرَ + ال=الشَّهْرَ) বলা হয়, তখন সুস্পষ্টভাবে ও সুনির্দিষ্টভাবে আল-কুর’আন নাযিলের সেই রামাদ্বন মাসটিকেই বোঝানো হয়, তার পরের বছরের রমাদ্বান মাস না।
উল্লেখ্য যে, شَهْرُ শব্দের অর্থ- ঘোষণাও বা ঘটনাও হতে পারে। এই শব্দ ধরলেও সুনির্দিষ্ট ভাবে আল-কুর’আন নাযিলের সেই ষোষণা বা ঘটনাকেই বোঝায়। পরবর্তী সময়ের কিছু না।
আপনি-আমি কি আল-কুর’আন নাযিল প্রত্যক্ষ করছি বা করেছি? আমাদের বাপ-দাদাদের বাপ-দাদারা কেউ কি আল-কুর’আন নাযিলের রমাদ্বান মাস শাহিদা বা প্রত্যক্ষ করেছে???
আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, লেখা আছে ফা-মান (فَمَنْ)/ যে কেউ/Whoever…. অর্থাৎ যে কুর’আন নাযিলের সুনির্দিষ্ট সেই রমাদ্বান মাস (অথবা ঘটনা দেখবে/ঘোষণা) শুনবে… অর্থাৎ কেউ তা প্রত্যক্ষ করতেও পারে, না-ও পারে। প্রত্যক্ষ করা বা শাহিদা (شَهِدَ); আমরা বলি- সাক্ষ্য দেওয়া- শাহাদা। না পেলে না শুনলে সাক্ষ্য দেওয়াও যায় না, প্রত্যক্ষ করাও যায় না। অর্থাৎ, এই মাস/ঘটনা/ঘোষণা- যে প্রত্যক্ষ করবে, কেউ করবে না। এজন্যই বলা হয়েছে ফা-মান (فَمَنْ)। এসময় যারা অসুস্থ ছিল বা সফরে ছিল, সেসব বিশ্বাসীরাও যেন ফিরে এসে আল-কুর’আন অধ্যয়নের সিয়ামে যোগ দেয়।
ফা-মান শাহিদা মিনকুম আশ-শাহরা, অতঃপর সে সিয়াম করুক (فَلْيَصُمْهُ)!
অতীতের শর্তটি দেখা যাচ্ছে নিশ্চয়ই! অন্য সব কুতিবা (كُتِبَ)–এর মতো কুতিবা আলাইকুম আস-সিয়ামও ছিল শর্তযুক্ত। সেই শর্ত হলো, অবশ্যই আল-কুর’আন নাযিলের সুনির্দিষ্ট সেই মাসটি আশ-শাহরা (الشَّهْرَ) প্রত্যক্ষ করতে হবে। অন্য কোনো বছরের রমাদ্বান মাস না!
দেড় হাজার বছর অতীতে এবং তারও আগে আস-সিয়াম (الصِّيَامُ) কুতিবা করার কারণ ছিল লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন বা যাতে তোমরা সজাগ-সচেতন হও (لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ)। তারও আগের মানুষদের জন্য সিয়াম কুতিবা ছিল। রমাদ্বান মাস নয়। অর্থাৎ, মূল গুরুত্ব আস-সিয়ামে। অন্য কোনো বিষয়ে না।
আর এই সিয়ামের উদ্দেশ্য টাকা-পয়সা দেওয়া নয়, পানাহার বন্ধ করা নয়, ঈদ উদযাপন করা নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যে বিশাল মুনাফা কামাই করাও নয়… কোনো কিছুই নয়! শুধুমাত্র মানুষ যাতে ইত্তাকু বা নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী সজাগ-সচেতন হতে পারে।
বহু যুগ, বহু প্রজন্ম, বহু শতাব্দী ধরে রোজা আছে বাঙালিরা, পাকিস্তানিরা, আফগানিরা, পারসিয়ানরা, আরবরা! এমনকি একনিষ্ঠ হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিষ্টানরাও উপবাস থাকে,…. রোজা বা উপবাস বা পানাহার বন্ধ রেখে তাদের এবং আমাদের কেউ কি ‘লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন’ হয়েছে? চারদিকে খুঁজে দেখুন। কারা সজাগ-সচেতন-চিন্তাশীল সঠিক পথের অনুসারী উত্তম মানুষ হয়ে উঠেছে! কারা তারা!
আসলেই কিছু মানুষ তেমন মুত্তাকি হয়েছে; তারা তাত্তাকুন (تَتَّقُوْنَ) বা সজাগ-সচেতন হয়েছে!
কীভাবে ও কেন? সেটাই দেখবো আমরা। সেটাই হলো আস-সিয়ামের অর্থ।
২নং সুরার ১৮৩ থেকে ১৮৯ পর্যন্ত আয়াতে দেড় হাজার বছর আগের পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী কীভাবে আস-সিয়াম করতে হবে সেই দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়। এখানে সর্বোচ্চ সঠিক অনুবাদ তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো। আপাতত সিয়াম শব্দের অর্থ ‘সিয়াম’-ই রাখা হলো। (অনুবাদগুলো কমেন্ট বক্সে)
· ২:১৮৭ তোমাদের জন্য বৈধ (اُحِلَّ لَكُمْ) আস-সিয়ামের রাতে (لَيْلَةَ الصِّيَامِ) তোমাদের স্ত্রীদের কাছে যাওয়া (الرَّفَثُ); তারা তোমাদের লিবাস ও তোমরা তাদের লিবাস (هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَاَنْتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ); আল্লাহ জানেন তোমরা যে প্রতারণা/বঞ্চনা করতে (تَخْتَانُوْنَ) নিজেদের সঙ্গে (اَنْفُسَكُ); তিনি তোমাদের ওপর সু-নজর (فَتَابَ) দিলেন ও ক্ষমা করলেন (عَفَا); সুতরাং এখন (فَٱلْـَٰٔنَ) তাদের/নারীদের সুসংবাদ দাও (بَٰشِرُوهُنَّ) এবং অনুসন্ধান করো (وَابْتَغُوْا) যা আল্লাহ লিখে দিয়েছেন তোমাদের জন্য (مَا كَتَبَ اللّٰهُ لَكُمْ); গ্রহণ করো- আত্মস্থ করো (وَكُلُوْا وَاشْرَبُوْا Consume and absorb) যতক্ষণ-না তোমাদের কাছে স্পষ্ট হয় (يَتَبَيَّنَ) সাদা সুতা থেকে কালো সুতা (الْخَيْطُ الْاَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْاَسْوَدِ)- প্রভাত হতে (مِنَ الْفَجْرِ); তারপর সম্পন্ন করো আস-সিয়াম (ثُمَّ اَتِمُّوا الصِّيَامَ) রাতের দিকে (اِلَى الَّيْلِ); এবং তাদের/নারীদের সুসংবাদ (تُبَٰشِرُوهُنَّ) দিওনা- যখন তোমরা কাজে মগ্ন (عَاكِفُوْنَ Working) আনুগত্যের সমাবেশ-স্থলে (فِى الْمَسٰجِدِ); এসব আল্লাহর সীমারেখা (حُدُوْدُ اللّٰهِ) তাই তার ধারে-কাছেও যাবে না (فَلَا تَقْرَبُوْهَا); এভাবেই আল্লাহ মানবজাতিকে বর্ণনা করেন (يُبَيِّنُ) তাঁর আয়াত (اٰيٰتِهٖ)- যাতে তারা সচেতন হবে (لَعَلَّهُمْ يَتَّقُوْنَ)।
সিয়াম (الصِّيَامُ) শব্দের পাঠোদ্ধার চেষ্টা:
আস-সিয়াম বা সিয়াম (الصِّيَامُ) শব্দটির ধাতু (রুট ওয়ার্ড) স্বদ-ওয়া-মিম। বিভিন্ন ভাবে কয়েকটি শব্দ তৈরি হয়েছে এখান থেকে। প্রধানতম শব্দ হলো- সিয়াম অথবা আস-সিয়াম/ The Siyam.
মহাগ্রন্থের অন্যান্য ‘সিয়াম’ লেখা শব্দের অনুবাদে রোজা লিখলেই সচেতন পাঠক বুঝতে পারেন যে—তা অর্থহীন বিষয় হয়ে যায়। যেমন- যে একজন মু’মিন ব্যক্তিকে হত্যা করবে, সে ক্ষতিপূরণ দিতে ব্যর্থ হলে সে দুই মাস (صِيَامُ شَهْرَيْنِ) রোজা রাখবে/ DO FASTING (!)- এমন হাস্যকর অনুবাদ করা হয়েছে। (দেখুন ৪:৯২)
আপনি যদি মনে করেন, একজন মু’মিন (শান্তিপ্রিয় ভালো মানুষ) হত্যাকাণ্ডের শাস্তি হলো- দুই মাস সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত না খেয়ে শরীর-মন ফিট করা (!) আর এতেই অপরাধী নিরপরাধ হয়ে যেতে পারে বা সংশোধিত হয়ে যেতে পারে—তাহলে নিশ্চয়ই আপনি বিরাট ভুলের মধ্যে আছেন! এটা যদি কোনো সমাজের আইনে পরিণত হয়- সে সমাজে ব্যাপকহারে হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাবে!
এ অবস্থায় উপায় কি? প্রকৃত বিষয় কি? সিয়াম মানে কি?
অর্থাৎ, মহাগ্রন্থের যেসব স্থানে আস-সিয়াম পাওয়া যায়, সেসব স্থানে একই অর্থ অনুবাদ করতে হবে। অবশ্যই সে অনুবাদ সবখানে যৌক্তিক অর্থপূর্ণ হতে হবে। অর্থহীন, গুরুত্বহীন কোনো শব্দ বসিয়ে দিলে তা ভাষার দৃষ্টিকোণ থেকেও অযৌক্তিক হয়ে পড়বে।
এর আগেই আমরা জেনেছিলাম ‘কুতিবা’ অর্থ কি?
এবার আমরা সিয়াম অর্থ দেখবো।
উল্লেখ্য যে, দুই ধরনের ‘সিয়াম’ শব্দ পাওয়া যায়। একটি শুধু সিয়াম (صِيَامُ), আরেকটি আস-সিয়াম (الصِّيَامُ)।
যেমন, সিয়ামু ও সিয়ামিন (২:১৯৬ صِيَامٍ/ صِيَامُ)/সাওমান (১৯:২৬ صَوْمًا)/সিয়ামান (৫:৯৫ صِيَامًا)/সুমু (২:১৮৪ صُومُوا)।
পাশাপাশি, ‘আল’ (The) বা সুনির্দিষ্ট সিয়াম নির্দেশক শব্দগুলো হলো- আস সিয়ামু (২:১৮৩ الصِّيَامُ), আস-স্বয়িমা (৩৩:৩৫ الصَّائِمَا), আস-স্বইয়ামা ও আস-স্বইয়ামি (২:১৮৭ الصِّيَامَ, الصِّيَامِ)।
এই আয়াতগুলোতে যেসব কথা বলা হয়েছে- সেখানে শরীর-স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী পানাহার না-করা বা রোজা/উপবাস কোনোভাবেই খাপ খায় না। অথচ দেখা যাচ্ছে যে, সিয়ামের মাধ্যমে বিভিন্ন স্বেচ্ছা-অপরাধী বা অন্যায়কারী ব্যক্তি তার মন-মগজ-চরিত্র সংশোধনের সুযোগ পায় এবং সমাজের জন্য ভালো মানুষে পরিণত হয়।
বোঝার সুবিধার্থে দেড় হাজার বছর আগের সময়কে প্রথম যুগ ধরি। সে সময় ‘সিয়াম’ ছিল মহাজগতের প্রভুর বাণী (আল-কুর’আন) সম্পর্কে জানার বিশেষ কর্মসূচি; যা শুধুমাত্র কুর’আন নাযিলের সময়ই প্রথমবার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে সময় আরব সমাজে কিন্তু কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না!
তারপর থেকে পরবর্তী যুগে সামাজিক নেতৃত্বের অধীনে সবসময় পরিচালিত থাকবে- এমন ‘সংশোধনমূলক কর্মসূচি’ হলো সিয়াম বা সাওম। তা ছাড়া কীভাবে ও কেন অপরাধীদের সিয়াম করতে বলা হয়েছে? তারা তো স্বেচ্ছায় অপরাধ করেছে, এবার কি তারা স্বেচ্ছায় ভালো হয়ে যাবে? অপরাধীরা স্বেচ্ছায় সজাগ সচেতন চিন্তাশীল হয়ে উঠবে?
হত্যাকাণ্ড থেকে এমন নানা অপরাধে অপরাধী মানুষকে সংশোধনের জন্য। যেমন আছে নরওয়ে সহ অনেক দেশে।
তাই বোঝা যায় যে, সিয়াম শব্দটির অর্থ- ‘গভীরভাবে পড়াশোনা, আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া, লেখাপড়া ও অধ্যয়ন-গবেষণা কাজের’ সঙ্গে যুক্ত। শুধুমাত্র এই শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমেই যুগ যুগ ধরে মানুষ কুসংস্কার ও অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে উঠছে।
মানুষ ধীরে ধীরে সজাগ-সচেতন-চিন্তাশীল হয়ে উঠছে। বর্তমান বিশ্বের তুলনামূলক উন্নত সমাজ ও রাষ্ট্রগুলোতে দেখুন। তাদের উন্নয়নের অন্যতম কারণই হলো শিক্ষা-দীক্ষা-জ্ঞান-গবেষণা।
পাশাপাশি, জগতের শিক্ষা-গবেষণার কোন বিভাগটি মহান রবের মহাগ্রন্থের বাইরের বিষয়? কোন বিষয়টি মহান রবের জ্ঞানের বাইরে তৈরি হয়েছে?! সব ধরনের জ্ঞানই মহান আল্লাহ এবং তাঁর পাঠানো মহাগ্রন্থের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। আর সার্বিক বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা এবং আত্মোন্নয়নই মূলত আস-সিয়াম!
এই সিয়ামই কুতিবা হয়েছিল পূর্ববর্তীদের এবং পরবর্তী সবার ওপর। এই প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা থেকে উচ্চতর পর্যায়ের জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা মানুষের অন্তরে/নফসে/আত্মায়/চেতনায় খোদাই করে দেওয়া হয়েছে। সেই অনুপ্রেরণাতেই চরম অন্ধকার থেকেও মানুষ জ্ঞানের পথ ধরে আলোকিত মহাবিশ্বে উঠে আসে! এটাই মানবাত্মার বিকাশ, মানব মননের বিকাশ, মানবসভ্যতার বিকাশ। ধারণা করা যায়, পৃথিবীর জীবনে একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত মানুষের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বিষয়গুলো বিকশিত হতে পারে। আর সেই পূর্ণ বিকাশের পথে হঠাৎ করে ধেয়ে আসে মৃত্যু। পরবর্তী জীবনেও সে বিকাশের ধারা অব্যাহত থাকবে। সে কথাই বহুবার বিভিন্নভাবে জানানো হয়েছে মহাগ্রন্থে।
এমতাবস্থায়, সিয়াম ও আস-সিয়ামের অনুবাদ করা যায়-
সিয়াম: জ্ঞানার্জন কার্যক্রম
আস-সিয়াম: জ্ঞানার্জনের সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা
এই উৎসাহ-উদ্দীপনা-প্রেরণার আলোকেই সমাজে, দেশে, রাষ্ট্রে কিন্ডারগার্টেন-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে। দেশে দেশে শিক্ষানীতি গড়ে উঠেছে। তা মনঃপুত না হলে আমরাই বিক্ষোভ প্রতিবাদ করে থাকি। দেশ ও সমাজের শিক্ষিত-সজাগ-সচেতন (মুত্তাকি) মানুষগুলো বক্তব্য-বিবৃতি, আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেয়। পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশন, অনলাইন-অফলাইন নিন্দা-সমালোচনার ঢেউ ওঠে। যাতে শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়।
এ অবস্থায়, প্রথম আস-সিয়াম শব্দটি আসে ২:১৮৩ আয়াতে। কুতিবা আলাইকুম আস-সিয়াম (كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ) অর্থ-
তোমাদেরকে জ্ঞানার্জনের সুনির্দিষ্ট কার্যক্রমে জোর উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
এর আগে, ২:১৭৯-১৮২ পর্যন্ত সমাজে ‘কিসাস‘ ও ‘ওসিয়াত‘ যে কুতিবা করা হয়েছে, সে কথা জানিয়ে দেওয়া হলো। সিয়াম ২য় পর্বে আমরা সেই কুতিবা বিস্তারিত পড়েছি। এই কুতিবা সমাজ/দেশ/রাষ্ট্রকে উন্নয়নের দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়।
এবার আসুন মিলিয়ে দেখি- আমাদের দাবি করা এই যৌক্তিক অনুবাদ সিয়াম সম্পর্কিত অন্যান্য আয়াতে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় কিনা!
২:১৯৬ আয়াতে প্রচুর জালিয়াতি অনুবাদ করা হয়েছে! সেই জাল অনুবাদ পড়েও বোঝা যায়, সে সময় সেখানে একটা অপরাধ ও শাস্তির কথা বলা হয়েছিল। মহান রব শাস্তি ও সংশোধন স্বরূপ অপরাধীদের তিন দিন ও সাত দিনের সংশোধনমূলক জ্ঞানার্জন কর্মসূচির
কথা উল্লেখ করেছেন। এর অন্যথা হলে দিয়েছেন- হুঁশিয়ার! আল্লাহ কিন্তু শাস্তিদানে কঠোর (وَاعْلَمُوْٓا اَنَّ اللّٰهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ)!
৪:৯২ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে ভুলবশত ভালো মানুষ হত্যাকাণ্ডের নানা ধরনের জরিমানা/শাস্তি যদি প্রয়োগ করা না যায়, তখন তাকে ‘দুই মাস সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রুদ্ধদ্বার জ্ঞানার্জনের কর্মসূচিতে’ রাখতে হবে (فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ); যা সুস্পষ্টভাবে বিশেষ ধরনের হত্যাকাণ্ডের সর্বশেষ পর্যায়ের শাস্তি।
৫:৮৯-এ সুস্পষ্ট যে, গুরুত্বপূর্ণ ওয়াদা/প্রতিজ্ঞা/চুক্তি ভঙ্গের শাস্তি হলো ১০জন দরিদ্র ব্যক্তিকে খাওয়ানো অথবা পোশাক দেওয়া অথবা বন্দী মুক্ত করা। এতে অক্ষম হলে তাকে (সংশোধনমূলক শাস্তি হিসেবে) সংশ্লিষ্ট বিষয়ের জ্ঞানার্জন কর্মসূচিতে তিন দিনের জন্য অন্তরীণ করা (فَصِيَامُ ثَلٰثَةِ اَيَّامٍ)!
৫:৯৫ আয়াতেও সুস্পষ্ট জাল অনুবাদ। তারপরও বোঝা যায়- অন্যায়ভাবে এবং জেনেশুনে অন্যের পশু হত্যার মামলা মিটমাট করতে হবে। তারপর বিচারকদের নির্দেশ অনুযায়ী অপরাধীকে শাস্তি-জরিমানা বা কাফফারা (كَفَّٰرَةٌ) হিসেবে কিছু দরিদ্রকে খাওয়াতে হবে; অথবা তার জেনেশুনে অপরাধ করার মানসিকতা সংশোধনের জন্য শিক্ষামূলক/জ্ঞানার্জনের কর্মসূচিতে (صِيَامًا) অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেখানে দেশ-সমাজের আইন, অপরাধের ক্ষয়ক্ষতির সামাজিক প্রভাব, মহান স্রষ্টার হুঁশিয়ারি/সতর্কতা ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান দেওয়া হবে।
১৯:২৬ আয়াতে স্বওমান (صَوْمًا) শব্দটি আছে। ২৩, ২৪, ২৫ ও ২৬নং আয়াত পড়লে বোঝা যায়, দেখা যাচ্ছে মারিয়াম গর্ভের সন্তান (ঈসা) নিয়ে এবং খাবার ও পানি-সহ দূরে একাকী কোথাও অবস্থান করছে। এ অবস্থায় যদি কোনো মানুষ কথা বলতে আসে, স্পষ্ট জানিয়ে দাও- নিশ্চয়ই আমি আর-রহমানের সিয়ামে শপথবদ্ধ (اِنِّيْ نَذَرْتُ لِلرَّحْمٰنِ صَوْمًا)। অর্থাৎ, মহান আল্লাহর দেওয়া বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা-অধ্যয়নের বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই এসময় কারও সঙ্গে কথা বলব না (فَلَنْ اُكَلِّمَ الْيَوْمَ اِنْسِيًّا)!
মারিয়াম বিশেষ প্রক্রিয়ায় গর্ভধারণ করেছেন, একাকী সন্তান প্রসব করেছেন এবং সেই সন্তানকে নিয়ে লোকালয়ে ফিরে করণীয় বিষয় নিয়ে মহান আল্লাহ সবসময় তাঁকে গাইড করেছেন। এসবই তাঁর ওপর ওহি (অনুপ্রেরণা) নাযিল করা হচ্ছিল। যা তাঁকে একনিষ্ঠভাবে রুদ্ধদ্বার চিন্তা-গবেষণা-অধ্যয়নের মাধ্যমেই অনুধাবন করতে হয়েছিল। সেটাই মারিয়ামের সিয়াম (صَوْمًا)।
৩৩:৩৫ আয়াতে আস-স্বইয়ামা (وَالصَّاۤىِٕمِيْنَ وَالصّٰۤىِٕمٰتِ) বা জ্ঞানার্জনের সুনির্দিষ্ট কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী পুরুষ ও নারীদের জন্য মহান রবের পক্ষ থেকে রয়েছে ক্ষমা ও মহা পুরস্কার (مَّغْفِرَةً وَّاَجْرًا عَظِيْمًا)।
৫৮:৪ আয়াতের বিষয়বস্তু শুরু হয়েছে প্রথম আয়াত থেকে পারিবারিক এই অপরাধটি সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক অপরিপক্বতার সঙ্গে জড়িত। এজন্য একটি সংশোধনমূলক শাস্তি হলো- দুই মাস টানা সিয়াম বা জ্ঞানার্জন করে শোধরানোর কর্মসূচিতে (فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ) অংশগ্রহণ করা।
সর্বমোট এই ১১বার সিয়াম সম্পর্কিত বক্তব্যগুলো মহাগ্রন্থে পাওয়া যায়।
মজার ব্যাপার হলো ৬৬:৫ আয়াতের সায়িহাতি (سَٰٓئِحَٰتٍ) শব্দের অর্থও Fasting/রোজা লেখা হয়েছে। বিস্ময়কর নয় কি ?!?
বিভিন্ন ধরনের অপরাধ যেমন, সামাজিক/রাষ্ট্রীয় নির্দেশ অমান্য করা, ভুল করে মানুষ হত্যা করা, নিষেধ উপেক্ষা করে পশু হত্যা করা, স্ত্রীর সঙ্গে গোপন আচরণ প্রচার করা এবং ঠান্ডা মাথায় প্রতিজ্ঞা-চুক্তি ভঙ্গ করার শাস্তি বা জরিমানা হলো বিভিন্ন মেয়াদের সিয়াম বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ভিত্তিক সংশোধনমূলক বাধ্যতামূলক জ্ঞানার্জন কর্মসূচি।
আর, শাস্তি নিশ্চয়ই কোনো ব্যক্তি নিজেই নিজেকে দেয় না! অবশ্যই দেশ, সমাজ, গোত্র কর্তৃপক্ষই অপরাধ শনাক্ত করে, বিচার করে ও শাস্তি দেয়। যেমন, কিছু আগে নরওয়ে ও চীনের উদাহরণে আমরা দেখেছি। অন্যান্য অনেক উন্নত দেশেও এমন সংশোধনের কর্মসূচি রয়েছে নিশ্চয়ই। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।
এর পাশাপাশি, বর্তমান বিশ্বে সজাগ-সচেতন, চিন্তাশীল ও যুক্তিবাদী মানুষ গঠনের সব ধরনের শিক্ষামূলক কর্মসূচিই আস-সিয়ামের অন্তর্ভুক্ত। যা কুতিবা হয়েছে বিশ্বাসীর ওপর। এই কর্মসূচীর প্রয়োগ ও উত্তমরূপে ব্যবহারের সীমা অসীম-তুল্য। মানব সন্তানকে ‘মানুষ’ হিসেবে গঠন করাই এই বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গির আস-সিয়ামের লক্ষ্য। এই সিয়াম বা জ্ঞানার্জন কার্যক্রম ও অগ্রযাত্রা অন্যসব প্রাণীর তুলনায় মানুষকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দিয়েছে। এই জ্ঞানার্জন কার্যক্রমের পথ ধরে রক্ত-চর্ম-হাড়ের নশ্বর মানবদেহকে ছাপিয়ে প্রকাশিত হয় প্রকৃত মানুষ। সুপ্ত পশুত্বকে দমন করে সূর্যালোকের মতো উদ্ভাসিত হয় উন্নত উজ্জীবিত মানবাত্মা।
সার কথা:
ইয়া আয়্যুহাল্লাযিনা আমানু, কুতিবা আলাইউকুম আস-সিয়াম, কামা কুতিবা আলাল্লাযিনা মিন কবলিকুম, লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন। (২:১৮৩)
সোজা-সাপটা সর্বোচ্চ সঠিক অনুবাদের চেষ্টা করলে দাঁড়ায়:
হে বিশ্বাসী-ভালো মানুষ, তোমাদের ওপর আনুষ্ঠানিক জ্ঞানার্জনে জোর
প্রেরণা-তাড়না-উৎসাহ দেওয়া হলো, যেমন উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল তোমাদের আগে, যাতে তোমরা সজাগ-সচেতন মানুষ হও।
বহু যুগ, বহু প্রজন্ম, বহু শতাব্দী ধরে রোজা আছে বাঙালিরা, পাকিস্তানিরা, আফগানিরা, পারসিয়ানরা, আরবরা! এমনকি একনিষ্ঠ হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিষ্টানরাও উপবাস থাকে,…. রোজা বা উপবাস বা পানাহার বন্ধ রেখে তাদের এবং আমাদের কেউ কি ‘লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন’ হয়েছে?
চারদিকে খুঁজে দেখুন। কারা সজাগ-সচেতন-চিন্তাশীল সঠিক পথের অনুসারী উত্তম মানুষ হয়ে উঠেছে! কারা তারা!
আসলেই কিছু মানুষ তেমন মুত্তাকি হয়েছে; তারা তাত্তাকুন (تَتَّقُوْنَ) বা সজাগ-সচেতন হয়েছে!
কীভাবে ও কেন? সেটাই দেখবো আমরা। সেটাই হলো আস-সিয়ামের অর্থ।
২নং সুরার ১৮৩ থেকে ১৮৯ পর্যন্ত আয়াতে দেড় হাজার বছর আগের পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী কীভাবে আস-সিয়াম করতে হবে সেই দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়। এখানে সর্বোচ্চ সঠিক অনুবাদ তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো। আপাতত সিয়াম শব্দের অর্থ ‘সিয়াম’-ই রাখা হলো। (অনুবাদ কমেন্ট বক্সে)
২:১৮৩ ওহে যারা ঈমান এনেছ, তোমাদের উপর আস-সিয়াম (الصِّيَامُ) জোরালো প্রেরণা দেওয়া হয়েছে (كُتِبَ-কুতিবা) যেমন জোরালো প্রেরণা (كُتِبَ-কুতিবা) হয়েছিল তোমাদের আগে (عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ)- যাতে তোমরা সজাগ-সচেতন হও (لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ)।
২:১৮৪ নির্দিষ্ট সময়ের/দিনের (اَيَّامًا مَّعْدُوْدٰتٍ); অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হয় (فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَّرِيْضًا) অথবা ভ্রমণে থাকে (اَوْ عَلٰى سَفَرٍ) অন্য দিন/সময় থেকে সংখ্যা পূর্ণ করুক (فَعِدَّةٌ مِّنْ اَيَّامٍ اُخَرَ); আর যে সামর্থ্যবান সে (يُطِيقُونَهُ) বিনিময় হিসেবে (فِدْيَةٌ) এক অভাবীকে (مِسْكِينٍ) খাদ্য দান করবে (طَعَامُ); অতঃপর যে স্বেচ্ছায় (تَطَوَّعَ) ভালো কাজ করে (خَيْرًا) তার জন্য সেটাই উত্তম (فَهُوَ خَيْرٌ لَّهٗ); আর সিয়াম করাই (تَصُوْمُوْا) তোমাদের জন্য উত্তম (خَيْرٌ لَّكُمْ), যদি তোমরা বোঝো (اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ )।
২:১৮৫ রমাদ্বানের/উত্তপ্ত সময়ের মাস (شَهْرُ رَمَضَانَ)- তাতে নাযিল হয়েছিল আল-কুর’আন (الَّذِيْٓ اُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْاٰنُ)- মানবজাতির জন্য পথ-নির্দেশনা (هُدًى) ও পথ-নির্দেশের সুস্পষ্ট বর্ণনা (بَيِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰى) এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী (وَالْفُرْقَانِ); অতএব তোমাদের মধ্যে যে সেই মাসটি পাবে (فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ), অতঃপর সে সিয়াম করুক (فَلْيَصُمْهُ); আর যে অসুস্থ (مَرِيضًا) অথবা ভ্রমণে আছে (سَفَرٍ) সে অন্য সময় থেকে সংখ্যা পূর্ণ করুক (فَعِدَّةٌ مِّنْ اَيَّامٍ اُخَرَ); আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ (ٱلْيُسْرَ) চান, তোমাদের জন্য কঠোরতা (ٱلْعُسْرَ) চান না; যেন তোমরা পূর্ণ করতে পার মেয়াদ/সংখ্যা (ٱلْعِدَّةَ); এবং তোমাদেরকে সৎপথ দেখানোর জন্য (هَدَىٰكُمْ) তোমরা আল্লাহর মাহাত্ম্য-বড়ত্ব ঘোষণা করো (لِتُكَبِّرُوا۟); আর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও (لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ)।
২:১৮৬ আর যখন আমার বান্দারা (عِبَادِى) আমার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে (سَأَلَكَ), তখন নিশ্চয়ই আমি নিকটে (فَاِنِّيْ قَرِيْبٌ); কোনো আহ্বানকারী যখনই ডাকে তখনই আমি আহ্বানে সাড়া দেই (اُجِيْبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ اِذَا دَعَانِ); সুতরাং তারাও আমাকে সাড়া দিক (فَلْيَسْتَجِيْبُوْا لِيْ) এবং আমাকে বিশ্বাস করুক (وَلْيُؤْمِنُوْا بِيْ)- যাতেতারা সুপথ পায় (لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُوْنَ)।
২:১৮৭ তোমাদের জন্য বৈধ (اُحِلَّ لَكُمْ) আস-সিয়ামের রাতে (لَيْلَةَ الصِّيَامِ) তোমাদের স্ত্রীদের কাছে যাওয়া (الرَّفَثُ); তারা তোমাদের লিবাস ও তোমরা তাদের লিবাস (هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَاَنْتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ); আল্লাহ জানেন তোমরা যে প্রতারণা/বঞ্চনা করতে (تَخْتَانُوْنَ) নিজেদের সঙ্গে (اَنْفُسَكُ); তিনি তোমাদের ওপর সু-নজর (فَتَابَ) দিলেন ও ক্ষমা করলেন (عَفَا); সুতরাং এখন (فَٱلْـَٰٔنَ) তাদের/নারীদের সুসংবাদ দাও (بَٰشِرُوهُنَّ) এবং অনুসন্ধান করো (وَابْتَغُوْا) যা আল্লাহ লিখে দিয়েছেন তোমাদের জন্য (مَا كَتَبَ اللّٰهُ لَكُمْ); গ্রহণ করো- আত্মস্থ করো (وَكُلُوْا وَاشْرَبُوْا Consume and absorb) যতক্ষণ-না তোমাদের কাছে স্পষ্ট হয় (يَتَبَيَّنَ) সাদা সুতা থেকে কালো সুতা (الْخَيْطُ الْاَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْاَسْوَدِ)- প্রভাত হতে (مِنَ الْفَجْرِ); তারপর সম্পন্ন করো আস-সিয়াম (ثُمَّ اَتِمُّوا الصِّيَامَ) রাতের দিকে (اِلَى الَّيْلِ); এবং তাদের/নারীদের সুসংবাদ (تُبَٰشِرُوهُنَّ) দিওনা- যখন তোমরা কাজে মগ্ন (عَاكِفُوْنَ Working) আনুগত্যের সমাবেশ-স্থলে (فِى الْمَسٰجِدِ); এসব আল্লাহর সীমারেখা (حُدُوْدُ اللّٰهِ) তাই তার ধারে-কাছেও যাবে না (فَلَا تَقْرَبُوْهَا); এভাবেই আল্লাহ মানবজাতিকে বর্ণনা করেন (يُبَيِّنُ) তাঁর আয়াত (اٰيٰتِهٖ)- যাতে তারা সচেতন হবে (لَعَلَّهُمْ يَتَّقُوْنَ)।
২:১৮৮ আর তোমরা পরস্পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে (بِٱلْبَٰطِلِ) গ্রাস কোরো না (كُلُوٓا۟) এবং তোমরা তা নিয়ে বিচারকের কাছে তুলে দিও না (تُدْلُوا۟) যাতে তোমরা অবৈধভাবে (بِٱلْإِثْمِ) মানুষের ধনসম্পদের কিছু খেতে পারো (لِتَأْكُلُوا۟), আর তোমরা তা জানো।
২:১৮৯ তোমাকে জিজ্ঞেস করে- চাঁদ সম্পর্কে (الْاَهِلَّةِ); জানিয়ে দাও তা মানুষের জন্য সময়-নির্ধারক (مَوَٰقِيتُ) ও সুনির্দিষ্ট বিষয়ের সমাবেশ (ٱلْحَجِّ); এবং তোমরা পরিবারে (ٱلْبُيُوتَ) আসো/ঢোকো (تَأْتُوا۟) তার পেছন থেকে (ظُهُورِهَا)- যাতে কল্যাণ নেই, আর কল্যাণ কিন্তু সচেতনতায় (وَلٰكِنَّ الْبِرَّ مَنِ اتَّقٰى)!
এবং তোমরা তার সম্মুখ দরজা (اَبْوَابِهَا) দিয়ে পরিবারে (ٱلْبُيُوتَ) আসো/ঢোকো (وَأْتُوا۟); আর আল্লাহ সম্পর্কে সচেতন থাকো (وَاتَّقُوا اللّٰهَ) যাতে তোমরা সফল হও (لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ)।
এই বিস্তারিত অংশটি দেড় হাজার বছর আগের সময়ের লোকদের জন্য গাইডলাইন বা সিয়াম-সংক্রান্ত হুবহু পালনযোগ্য নির্দেশিকা। সেই সঙ্গে পরবর্তী সময়ের লোকদের জন্য শিক্ষামূলক নির্দেশনা।
এখানে সংক্ষেপে যা পাওয়া যায়..
২:১৮৩ তে বলা হলো- তোমরা সিয়াম করো- যেমন আগেও করা হতো। যাতে তোমরা সজাগ-সচেতন মানুষ হতে পারো (সম্পূর্ণ সভ্য মানুষ হবার নির্দেশ)।
২:১৮৪ তে- সিয়াম কর্মসূচি নির্ধারিত দিনের জন্য।
২:১৮৫ তে বলা হলো- যে/যারা (فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ) কুর’আন নাযিলের ঘটনা প্রত্যক্ষ করবে, সে/তারা যেন সিয়াম করে (فَلْيَصُمْهُ)। অর্থাৎ, আগ্রহীগণ যেন আল-কুর’আন নিয়ে সুনির্দিষ্ট জ্ঞানার্জনের কাজে/গবেষণায় যোগ দেয়। যা মূলত নির্ধারিত সময়ের কর্মসূচি।
২:১৮৬ তে- আশ্বাস ও অভয় দেওয়া হলো মহান রবের পক্ষ থেকে।
২:১৮৭ তে- কিতাবের সঙ্গে জড়িত সিয়ামের বিষয়ে কিছু গাইডলাইন দেওয়া হলো। প্রচলিত ভুলগুলো শুধরে দেওয়া হলো। যাতে তারা ‘সজাগ-সচেতন মানুষ’ হতে পারে।
২:১৮৮-এ বলা হলো- সমাজে অবৈধভাবে জবর-দখল-লুটতরাজ যেন না চলে (ফের সুসভ্য সমাজ গঠনের নির্দেশ)।
২:১৮৯তে- প্রতারণামূলক অসামাজিক একটা বিষয়ে সতর্ক করা হলো, আল্লাহ সম্পর্কে সচেতন হবার মাধ্যমে। যে প্রতারণার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল ১৮৭নং আয়াতে।
২:১৯০তে- লড়াই-সংগ্রাম-যুদ্ধের সময় (ফি সাবিলিল্লাহ) উন্নত নীতি-নৈতিকতা কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলো। নয়তো সভ্যতা তৈরি হবে না!
২:১৯১, ১৯২ এর বক্তব্য হলো- ফিৎনা-ফ্যাসাদ হত্যার চেয়েও জঘন্য (الْفِتْنَةُ اَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ)! সেটা যেন না হয়। সর্বোন্নত মানবিক বিকাশের নির্দেশনা দেওয়া হলো।
২:১৯৩ জানিয়ে দিলো- জুলুম-নির্যাতন যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ সংগ্রাম করতে হবে। শক্তিশালীদের নির্যাতন (Oppression) বন্ধ হলেই আল্লাহর দীন প্রতিভাত হবে।
..এভাবে ধারাবাহিকভাবে উন্নত সভ্যতা ও সমাজ গঠনের মানদণ্ড ও মৌলিক বিষয়গুলো বলা হতে থাকলো একের পর এক।
এবার আসুন মিলিয়ে দেখি- আমাদের দাবি করা এই যৌক্তিক অনুবাদ সিয়াম সম্পর্কিত অন্যান্য আয়াতে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় কিনা!
২:১৯৬ আয়াতে প্রচুর জালিয়াতি অনুবাদ করা হয়েছে! সেই জাল অনুবাদ পড়েও বোঝা যায়, সে সময় সেখানে একটা অপরাধ ও শাস্তির কথা বলা হয়েছিল। মহান রব শাস্তি ও সংশোধন স্বরূপ অপরাধীদের তিন দিন ও সাত দিনের সংশোধনমূলক জ্ঞানার্জন কর্মসূচির
কথা উল্লেখ করেছেন। এর অন্যথা হলে দিয়েছেন- হুঁশিয়ার! আল্লাহ কিন্তু শাস্তিদানে কঠোর (وَاعْلَمُوْٓا اَنَّ اللّٰهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ)!
৪:৯২ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে ভুলবশত ভালো মানুষ হত্যাকাণ্ডের নানা ধরনের জরিমানা/শাস্তি যদি প্রয়োগ করা না যায়, তখন তাকে ‘দুই মাস সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রুদ্ধদ্বার জ্ঞানার্জনের কর্মসূচিতে’ রাখতে হবে (فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ); যা সুস্পষ্টভাবে বিশেষ ধরনের হত্যাকাণ্ডের সর্বশেষ পর্যায়ের শাস্তি।
৫:৮৯-এ সুস্পষ্ট যে, গুরুত্বপূর্ণ ওয়াদা/প্রতিজ্ঞা/চুক্তি ভঙ্গের শাস্তি হলো ১০জন দরিদ্র ব্যক্তিকে খাওয়ানো অথবা পোশাক দেওয়া অথবা বন্দী মুক্ত করা। এতে অক্ষম হলে তাকে (সংশোধনমূলক শাস্তি হিসেবে) সংশ্লিষ্ট বিষয়ের জ্ঞানার্জন কর্মসূচিতে তিন দিনের জন্য অন্তরীণ করা (فَصِيَامُ ثَلٰثَةِ اَيَّامٍ)!
৫:৯৫ আয়াতেও সুস্পষ্ট জাল অনুবাদ। তারপরও বোঝা যায়- অন্যায়ভাবে এবং জেনেশুনে অন্যের পশু হত্যার মামলা মিটমাট করতে হবে। তারপর বিচারকদের নির্দেশ অনুযায়ী অপরাধীকে শাস্তি-জরিমানা বা কাফফারা (كَفَّٰرَةٌ) হিসেবে কিছু দরিদ্রকে খাওয়াতে হবে; অথবা তার জেনেশুনে অপরাধ করার মানসিকতা সংশোধনের জন্য শিক্ষামূলক/জ্ঞানার্জনের কর্মসূচিতে (صِيَامًا) অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেখানে দেশ-সমাজের আইন, অপরাধের ক্ষয়ক্ষতির সামাজিক প্রভাব, মহান স্রষ্টার হুঁশিয়ারি/সতর্কতা ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান দেওয়া হবে।
১৯:২৬ আয়াতে স্বওমান (صَوْمًا) শব্দটি আছে। ২৩, ২৪, ২৫ ও ২৬নং আয়াত পড়লে বোঝা যায়, দেখা যাচ্ছে মারিয়াম গর্ভের সন্তান (ঈসা) নিয়ে এবং খাবার ও পানি-সহ দূরে একাকী কোথাও অবস্থান করছে। এ অবস্থায় যদি কোনো মানুষ কথা বলতে আসে, স্পষ্ট জানিয়ে দাও- নিশ্চয়ই আমি আর-রহমানের সিয়ামে শপথবদ্ধ (اِنِّيْ نَذَرْتُ لِلرَّحْمٰنِ صَوْمًا)। অর্থাৎ, মহান আল্লাহর দেওয়া বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা-অধ্যয়নের বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই এসময় কারও সঙ্গে কথা বলব না (فَلَنْ اُكَلِّمَ الْيَوْمَ اِنْسِيًّا)!
মারিয়াম বিশেষ প্রক্রিয়ায় গর্ভধারণ করেছেন, একাকী সন্তান প্রসব করেছেন এবং সেই সন্তানকে নিয়ে লোকালয়ে ফিরে করণীয় বিষয় নিয়ে মহান আল্লাহ সবসময় তাঁকে গাইড করেছেন। এসবই তাঁর ওপর ওহি (অনুপ্রেরণা) নাযিল করা হচ্ছিল। যা তাঁকে একনিষ্ঠভাবে রুদ্ধদ্বার চিন্তা-গবেষণা-অধ্যয়নের মাধ্যমেই অনুধাবন করতে হয়েছিল। সেটাই মারিয়ামের সিয়াম (صَوْمًا)।
৩৩:৩৫ আয়াতে আস-স্বইয়ামা (وَالصَّاۤىِٕمِيْنَ وَالصّٰۤىِٕمٰتِ) বা জ্ঞানার্জনের সুনির্দিষ্ট কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী পুরুষ ও নারীদের জন্য মহান রবের পক্ষ থেকে রয়েছে ক্ষমা ও মহা পুরস্কার (مَّغْفِرَةً وَّاَجْرًا عَظِيْمًا)।
৫৮:৪ আয়াতের বিষয়বস্তু শুরু হয়েছে প্রথম আয়াত থেকে পারিবারিক এই অপরাধটি সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক অপরিপক্বতার সঙ্গে জড়িত। এজন্য একটি সংশোধনমূলক শাস্তি হলো- দুই মাস টানা সিয়াম বা জ্ঞানার্জন করে শোধরানোর কর্মসূচিতে (فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ) অংশগ্রহণ করা।
সর্বমোট এই ১১বার সিয়াম সম্পর্কিত বক্তব্যগুলো মহাগ্রন্থে পাওয়া যায়।
এসব বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে,
সিয়াম: জ্ঞানার্জন কার্যক্রম
আস-সিয়াম: জ্ঞানার্জনের সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা
হে বিশ্বাসী-ভালো মানুষ, তোমাদের ওপর আনুষ্ঠানিক জ্ঞানার্জনে জোর
প্রেরণা-তাড়না-উৎসাহ দেওয়া হলো, যেমন উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল তোমাদের আগে, যাতে তোমরা সজাগ-সচেতন মানুষ হও।