পর্বঃ১
Al-Baqarah ২:১৪৪
قَدْ نَرٰي تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَآءِ ۚ فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضٰهَا ۪ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ ؕ وَحَيْثُ مَا كُنْتُمْ فَوَلُّوْا وُجُوْهَكُمْ شَطْرَهٗ ؕ وَاِنَّ الَّذِيْنَ اُوْتُوا الْكِتٰبَ لَيَعْلَمُوْنَ اَنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّهِمْ ؕ وَمَا اللّٰهُ بِغَافِلٍ عَمَّا يَعْمَلُوْنَ
প্রচলিত অনুবাদ
নিশ্চয়ই আমি আপনাকে বার বার আকাশের দিকে তাকাতে দেখি। অতএব, অবশ্যই আমি আপনাকে সে কেবলার দিকেই ঘুরিয়ে দেব যাকে আপনি পছন্দ করেন। এখন আপনি মসজিদুল-হারামের দিকে মুখ করুন এবং তোমরা যেখানেই থাক, সেদিকে মুখ কর। যারা আহলে-কিতাব, তারা অবশ্যই জানে যে, এটাই ঠিক পালনকর্তার পক্ষ থেকে। আল্লাহ বেখবর নন, সে সমস্ত কর্ম সম্পর্কে যা তারা করে।
২ঃ১৪৪ এর প্রতিটি শব্দ বিশ্লেষণ করবো এখানে ইনশাআল্লাহ । আপনারা প্রচলিত অনুবাদ দেখে নিয়েন। সেখানে মসজিদ আল হারামের দিকে মুখ ফেরাতে বলেছে।
ক্বাদঃ নিশ্চয়ই
নারাঃ আমরা দেখেছি
তাক্বাল্লুবাঃ উথ্থান-পতন/Struggle/Facing challanges। ধাতু ক্বাফ-লাম-বা। তাক্বাল্লুব শব্দের মূল অর্থ হলো পরিস্থিতির কারণে শারীরিক ও মানসিক অবস্থা উঠানামা করা। একই ধাতু থেকে আসছে ক্বলব যার অর্থ হৃদয়। মানুষের হৃদস্পন্দনও পরিস্থিতির কারণে উঠানামা করে, তাই হৃদয়কেও ক্বলব বলে।
ওয়াজহিকাঃ তোমার সম্মান/আত্মবিশ্বাস/Honor/SelfConfidence/Objective/purpose/উদ্দেশ্য/লক্ষ্য। প্রচলিত অনুবাদে বেশিরভাগ আয়াতে ”মুখ” অনুবাদ করে। তবে ৩ঃ৪৫ ও ৩৩ঃ৬৯ দেখেন। আবার ২ঃ২৭২ এ “ওয়াজহি আল্লাহ” শব্দযুগলের প্রচলিত অনুবাদ করছে “আল্লাহর মুখ/চেহারা দেখার জন্য আমরা সহজলভ্য রাখি”- যা পুরোপুরিই ভুয়া। কারণ আল্লাহর চেহারা আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি কুরআনে। মুসা দেখতে চেয়েছিল আল্লাহকে ৭ঃ১৪৩ এ কিন্তু আল্লাহ তা করেননি। ২ঃ২৭২ এ “ওয়াজহি আল্লাহ” এর অনুবাদ হবে “তোমরা আল্লাহর সম্মানে/purpose/উদ্দেশ্যে যা তুনফিক্বুন/সহজলভ্য রাখো”।
ফি আল সামা’আঃ এ জগতের/World মধ্যে। সামা শব্দটাকে প্রচলিতভাবে শুধুমাত্র “আকাশ/Heaven” অনুবাদ করা হয়। আকাশ হলো এ বিশাল জগতের একটি অংশ মাত্র। সামা হলো পুরো জগৎ এবং ”আরজ” হলো পৃথিবী।
ফালানু ওয়াল্লি ইয়ান্নাকাঃ অতঃপর আমরা অবশ্যই রক্ষা করবো। ওয়ালি শব্দটার অর্থ হলো রক্ষা করা। মাওলা হলো রক্ষাকর্তা/Protector. আল্লাহ ছাড়া আমাদের কোনো মাওলা নেই।
ক্বিবলাতাঃ ইচ্ছা/সংকল্প/Desire/পরিকল্পনা/গ্রহনযোগ্যতা
ধাতু ক্বাফ-বা-লাম। বিয়ার সময় সবাই ক্ববুল ঠিকই বলেন, কারণ বিয়েতে দুপক্ষেরই ইচ্ছা/পরিকল্পনা/Desire মিলাতে হয়। ক্ববুল অর্থ গ্রহণ করাও হয়। যেমন ৩ঃ৩৬ এ আল্লাহ ক্ববুল করেন।
তারজাহাঃ যেভাবে সন্তুষ্ট হও। প্রচলিত অনুবাদটি ঠিক আছে।
ফা ওয়াল্লিঃ অতঃপর তুমিও রক্ষা করো
ওয়াজহাকাঃ তোমার সম্মান/আত্মবিশ্বাস/লক্ষ্য
শাতারাঃ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে/দূরে সরিয়ে/to be distant। “শাতারা” শব্দটি ২ঃ১৪৪-১৫০ এর মধ্যে ৫ বার ব্যবহৃত হয়েছে তাই ক্রস রেফারেন্স করা সম্ভব হয়নি। ডিকশনারি থেকে আমরা দেখতে পাই এর আদি অর্থ হলো “কোনো কিছু থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হওয়া।” পরবর্তীতে ধর্ম ব্যবসার করার উদ্দেশ্যে আরব ও পার্সিয়ান শাসকেরা এই শব্দটিকেই বেছে নিয়েছে দুর্নীতি করার জন্য।
আল মাসজিদ আল হারামঃ নিষিদ্ধ মাসজিদ থেকে
তাহলে এ পর্যন্ত অনুবাদঃ “নিশ্চয়ই আমরা দেখেছি তোমার সম্মানের/আত্মবিশ্বাসের/লক্ষ্যের উঠানামা এ জগতের মধ্যে। অতঃপর আমরা অবশ্যই রক্ষা করবো তোমার পরিকল্পনা/গ্রহনযোগ্যতা যেভাবে সন্তুষ্ট হও। অতঃপর তুমিও রক্ষা করো তোমার আত্মবিশ্বাস/লক্ষ্যকে নিষিদ্ধ মসজিদ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে।”
পরের অংশের অনুবাদগুলো সরসারি করা যাবে।
“এবং তোমরা যেখানেই থাকোনা না কেন নিজের আত্মবিশ্বাস/লক্ষ্যকে ইহা (নিষিদ্ধ মাসজিদ) হতে বিচ্ছিন্ন করো (শাতারাহু)। অবশ্যই তোমাদের পূর্বে যারা কিতাবপ্রাপ্ত তারা জানে যে এটাই তোমার রবের পক্ষ থেকে হক্ব/সঠিক। তারা যা করে, আল্লাহ সে সম্পর্কে অনবগত নন।”
আল্লাহ যা হারাম করেছেন সেগুলো মান্যরত অবস্থায় থাকাই হলো মাসজিদ আল হারাম।
যেমন শিরক, কুফরি, মানবহত্যা ইত্যাদি। মুসাও একজনকে অন্যায় ভাবে হত্যা/ অপমান /প্রতিরোধ করেছিল (২৮ঃ১৫) সেকারণে সে ছিল মাসজিদ আল হারামে। সেই রাতে তাকে যখন আল্লাহর নিদর্শন দেখানো হয়, তখন সে তওবা করে (৭ঃ১৪৩)। ১৭ঃ১-২ আয়াতে একারনে বলা হচ্ছে মুসার স্তরকে মসজিদুল হারাম থেকে দূরের মসজিদে সরিয়ে আনা/স্থানান্তর করা হয়েছে যা ছিল বরকতময় স্থানান্তর।
২ঃ১৪৪ আয়াতের শেষ অংশ অনুসারে যারা কিতাবপ্রাপ্ত ছিলেন তারা জানেন যে মসজিদ আল হারাম/নিষিদ্ধ মাসজিদ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে হক্ব। অতীতের সকল নবীরাসুল প্রথমেই সে কাজটি করেছেন। অর্থাৎ সকল নবী রাসুলই প্রথমে নিষিদ্ধ মাসজিদে ছিলেন এবং নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছেন।
যেমন ইব্রাহীম তার মুশরিক পিতার রবকে অস্বীকার করেছেন, মুসা একজনকে অন্যায় ভাবে হত্যা/আক্রমণ/কুতিলা করা সত্ত্বেও পরে আল্লাহর সাথে সরাসরি সাক্ষাত পেয়ে নিদর্শন দেখে তওবা করেছেন এবং নিষিদ্ধ মাসজিদ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ফিরাউনের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
এখানে কুরআনের অনুসারিরা সবাই বাপদাদার ধর্ম পালন করে এসেছে। অর্থাৎ সবাই নিষিদ্ধ মাসজিদে ছিল। এখনো অনেকেই সেখানে পড়ে আছেন, দুচারটা রীতি রেওয়াজ পালন করছেন যা আল্লাহ দেন নি। যতদিন আকড়ে পড়ে থাকবেন ততদিন কুরআনের আলো পুরোপুরি পৌঁছাবে না এবং লক্ষ্য পরিষ্কার হবে না।
কুরআনে আল্লাহর মসজিদ (২ঃ১১৪) আর নিষিদ্ধ মসজিদ (২ঃ১৪৪) একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত।
৯ঃ২৮
পর্ব-২
মাসজিদ আসছে সুজুদ থেকে, যার অর্থ মান্য করা বা মেনে নেয়া। মাসজিদ মানে মান্যরত অবস্থায় থাকা।
মাসজিদ আল হারাম হলো নিষিদ্ধ মাসজিদ। কাফির/মুশরিকরা যদি আল্লাহর দেয়া নিষিদ্ধ জিনিস (যেমন হত্যা, ফিতনা, ফ্যাসাদ, শিরক, ফুজারি/পাপাচার) মান্যরত অবস্থায় থাকে, তাহলে সেটাই হলো মাসজিদ আল হারাম।
মানব তৈরি মসজিদও হলো মাসজিদ আল হারাম বা নিষিদ্ধ মসজিদ (শিরকের আড্ডাখানা)। আর মুশরিকদের তৈরি রিচুয়ালের আড্ডাখানা হলো নিষিদ্ধ মাসজিদ। আর মুশরিকদের অপবিত্র বলেছেন আল্লাহ কুরআনে।
৯ঃ২৮ এর সঠিক অনুবাদ।
হে যারা ঈমান এনেছো!
ইন্নামা আলমুশরিকুনা নাজাসুনঃ নিশ্চয়ই মুশরিকরা নাপাক/অপবিত্র
“ফা লা ইয়াক্বরাবুঃ সুতরাং (ফা) কাছে যেওনা/এসোনা/নিকটবর্তী হইয়ো না (লা ইয়াক্বরাবু)”
আল মাসজিদ আল হারামঃ নিষিদ্ধ মাসজিদের
আর প্রচলিত অনুবাদে “ফা লা ইয়াক্বরাবু” কে দুর্নীতি করে লিখছে “সুতরাং তাদেরকে কাছে এনো না মাসজিদুল হারামে।” এই অংশে “তাদের” শব্দটার আরবি কোথায়? “ইয়াক্বরাবু” ক্রিয়ার পরে কি “হুন্না” বা “তাদেরকে” শব্দটা আছে?
যদি আল্লাহ বলতেন “ফা লা ইয়াক্বরাবুহুন্না ফি আল মাসজিদ আল হারাম” তাহলে প্রচলিত অনুবাদটা সঠিক হতো।
অর্থাৎ নিষিদ্ধ মাসজিদ হলো মুশরিকদের রিচুয়ালে ভরা। সুতরাং মুমিনদের অপবিত্র মুশরিক এবং তাদের মাসজিদ আল হারামের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করা হচ্ছে ৯ঃ২৮।
অথচ কত সহজে অনুবাদে দুর্নীতি করে বিষয়টাকে পুরাই বিপরীতমুখী করে রাখা হয়েছে (অর্থাৎ মাসজিদ আল হারাম কে পবিত্র মাসজিদ করে রাখা হয়েছে)
মক্কা
বাক্কা
ক্বাবা
বাইত
৩ঃ৯৬
৩ঃ৯৬
বাক্কা এর শুরুতে ”বি” preposition আছে যার অনুবাদ করা হয়নি প্রচলিত অনুবাদে। বি মানে with/সাথে/পাশাপাশি
বাক্কা কোনো স্থান নয়। এই শব্দের অর্থ হলো to separate/পার্থক্য সৃষ্টি করা/ব্যবধান গড়ে দেয়া (রুট বা-কাফ-কাফ)।
৩ঃ৯৬ সঠিক অনুবাদ
নিশ্চয়ই (ইন্না) প্রথম (আওলা) রূপরেখাটি/সংবিধান/পরিকল্পনা (বাইতি) প্রচলিত হয়েছিল/স্থাপন করা হয়েছিল (উদিআ) মানুষের জন্য (লিননাসি) যা ছিল (লিল্লাজি) পার্থক্য সৃষ্টির (বাক্কাতা) সাথে/পাশাপাশি (বি) বরকত/আশীর্বাদ (মুবারাকা) এবং পথপ্রদর্শন (হুদা) এ বিশ্বজগতের জন্য (লিলআলামিন)।
অর্থাৎ ইব্রাহিমকে দেয়া প্রথম রূপরেখা বা সংবিধানটি মুশরিক (বহুঈশ্বরবাদ) এবং মুমিনদের (একঈশ্বরবাদ) মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী/ব্যবধান গড়ে দেয়া সংবিধান যা পৃথিবীতে বরকত এবং হুদা/পথপ্রদর্শন এনেছিল।
২ঃ১২৫
ক্বাবা ইব্রাহিম
কুরআনের যে আয়াতটি দিয়ে ক্বাবাঘর বানিয়ে কোটি কোটি মানুষকে আরবের পৌত্তলিক ধর্ম পালন করিয়ে শিরকে লিপ্ত (মাসজিদ আল হারাম) করেছে সে আয়াতের সঠিক অনুবাদঃ
ওয়া জাআলনাঃ এবং যখন আমরা নির্ধারণ করেছি
বায়তা মাছাবাতাঃ পুরষ্কারময় রূপরেখা
বাইত/বায়তা/বুয়ুত মানে ঘর না। বরং পরিকল্পনা/ষড়যন্ত্র/সংবিধান/রূপরেখা। ৪ঃ৮১, ৪ঃ১০৮ দেখেন।
ছাওয়াব থেকে মাছাবাতা আসছে। ছাওয়াব মানে পুরষ্কার।
লিন্নাসিঃ মানুষের জন্য
ওয়া আমনাঃ এবং তা বিশ্বাসের নির্দেশ দিয়েছি
এখানে ঈমানের ক্রিয়াবাচক শব্দ হলো আমনা। শুরুতে আলিফ হামজা মানে এটা আদেশ মূলক ক্রিয়া।
ওয়া ইত্তাখিজু: এবং আদেশ দিয়েছি গ্রহণ করার। এখানেও শুরুতে আলিফ হামজা আছে যা তাখিহু: এর জন্য আদেশ মূলক ক্রিয়া। তাখিজু মানে গ্রহণ করা (২ঃ২৬৭, ৫১ঃ১৬, ২ঃ৬৩)
মিন মাকামি ইব্রাহিমা মুসাল্লানঃ ইব্রাহিমের প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্য/উদ্দেশ্য/আদর্শ থেকে অনুসরণ যোগ্য/অনুসরণীয় বিষয়।
মাক্বাম শব্দটা আক্বিম থেকে আসছে। আর মুসাল্লান হলো মুসাল্লি থেকে আসছে।
বাকি অংশঃ “এবং আমরা ইব্রাহিম ও ইসমাইলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছি যে তারা আমার এ রূপরেখা সমূহ (বায়তিয়া) পরিশুদ্ধ রাখবে (তাহিরা) তাওয়াফকারীদের জন্য, এবং আক্বিফকারীদের জন্য এবং রুক্কায়ি ও সুজুদিদের জন্য।”
তাওয়াফিনাঃ অনুসন্ধিৎসু/উৎসুক
আক্বিফুনাঃ একাগ্রচিত্তে ধ্যানকারী/গভীর চিন্তাবিদ
রুক্কায়িঃ বিনয়ীগণ/বিনয়ের সাথে অবনতগণ
সুজুদিঃ মান্যকারী
২ঃ১২৫ এ পুরো অনুবাদঃ
“এবং যখন আমরা মানুষের জন্য পুরষ্কারময় রূপরেখা নির্ধারণ করেছি এবং তা বিশ্বাসের নির্দেশ দিয়েছি এবং ইব্রাহিমের প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্য/আদর্শ থেকে অনুসরণযোগ্য/অনুসরণীয় বিষয় গ্রহণ করার আদেশ দিয়েছি এবং তখন আমরা ইব্রাহিম ও ইসমাইলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছি যে তারা যেন আমার এ রূপরেখাসমূহ পরিশুদ্ধ রাখে অনুসন্ধিৎসুদের জন্য এবং গভীর চিন্তাবিদদের জন্য এবং বিনয়ীদের জন্য ও মান্যকারীদের জন্য।”
মানুষের জন্য পুরষ্কারময় রূপরেখাটা হলো আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি ঈমান ও আমিলু সালিহা।