পর্ব ১ঃ
Al-Baqarah ২:১৩৯
قُلْ اَتُحَآجُّوْنَنَا فِي اللّٰهِ وَهُوَ رَبُّنَا وَرَبُّكُمْ ۚ وَلَنَاۤ اَعْمَالُنَا وَلَكُمْ اَعْمَالُكُمْ ۚ وَنَحْنُ لَهٗ مُخْلِصُوْنَ ۙ
আপনি বলে দিন, তোমরা কি আমাদের সাথে আল্লাহ সম্পর্কে তর্ক করছ? অথচ তিনিই আমাদের পালনকর্তা এবং তোমাদের ও পালনকর্তা। আমাদের জন্যে আমাদের কর্ম তোমাদের জন্যে তোমাদের কর্ম। এবং আমরা তাঁরই প্রতি একনিষ্ঠ।
বিশ্লেষণ
হজ্ব শব্দের ধাতু হা-জিম-জিম।
এর মূল/আদি অর্থ হলো To intend, to decide, to reason. অর্থাৎ “কোনো ব্যাপারে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে আলোচনা করে সেই ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া।”
যেহেতু বেশিরভাগ অনুবাদই পার্সিয়ান, গ্রামারও পার্সিয়ান এবং ডিকশনারিও পার্সিয়ান প্রভাব যুক্ত, তাই কুরআন অধ্যয়নের সর্বোত্তম পন্হা হলো ডিকশনারিতে/বইতে দেয়া আরবি শব্দগুলো আরবেরা দৈনন্দিন কাজে কিভাবে ব্যবহার করে/করতো, সেই অর্থটি গ্রহণ করে একটি সম্যক ধারণা নেয়া। যেমন প্রচলিত পার্সিয়ান অনুবাদও আছে আবার আরবেরা দৈনন্দিন জীবনে হজ্ব শব্দ বলতে কি বোঝে, কিভাবে অন্যান্য বাক্য গঠন করে সেটাও আছে। আমাদেরকে নিতে হবে সেটা।
হজ্জ বলতে কি বুঝায়?
হজ্জ হলো একটি যুক্তি/তর্ক/আলোচনার সম্মেলন।
যেমন;জাতি সংঘের বৈঠক, আসিয়ান সম্মেলনে, সার্ক সম্মেলন, জি- ৭ সম্মেলন, ও আই সি সম্মলন, আরবলীগ সম্মেলন সহ বিশ্বে যতগুলো সংস্থা আছে এবং মানবতার কল্যানে এদের যে সব আলোচনা বৈঠক তথা সম্মেলন সমাবেশ হয় তাই হজ্জ।বর্তমানে বিজ্ঞানিরা বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক সম্মেলনের আয়োজন করে সেখানে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে আলোচনা করে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হোন। এটাও হজ্ব।
কুরআনের হজ্জ কি?
উপরোল্লেখিত একই কাজ/যুক্তিতর্ক/সম্মেলন/আলোচনা যদি কুরআনের আয়াতের বিষয়ে করে থাকেন, তাহলে সেটি কুরআনিক হজ্ব।
এই সম্মেলন কিভাবে করবেন?
এই যুক্তিতর্কের সম্মেলন কিভাবে করবেন সেটা মানুষের ব্যাপার। শারিরীক ভাবে কোনো স্থানে হতে পারে বা বর্তমানে ভার্চুয়াল জুম মিটিং বা ফেসবুক গ্রুপেও হতে পারে। আসেন কিছু আয়াত দেখি হজ্ব শব্দগুলো কোথায় কোথায় ব্যবহৃত হয়েছে।
প্রমান
২ঃ৭৬
“যখন তারা মুমিনদের (আল্লাজিনা আমানু) সাথে সাক্ষাত করে (লাক্বু), তারা বলে আমরা ঈমান এনেছি (আমান্না), তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার যখন গোপণে অন্যদের সাথে সাক্ষাত করে তারা বলে, তোমরা কি তাদেরকে সেটাই বলো (আতুহাদিছুনাহুম) যা আল্লাহ তোমাদেরকে বলেছেন যাতে তারা তোমাদের সাথে Argue/যুক্তিতর্ক করে (লিইয়ুহাজ্জাকুম) সেটি নিয়ে (বিহি) তোমাদের রবের সামনে?”
২ঃ২৫৮
“তোমরা কি তাদের দেখো না যারা যুক্তিতর্ক/Argue করে (হাজ্জা) ইব্রাহিমের সাথে আল্লাহর ব্যাপারে কারণ আল্লাহ তাকে সাম্রাজ্য দিয়েছেন?”
একইভাবে হা-জিম-জিম থেকে উৎপন্ন সকল শব্দকে/verb কে তারা নিচের আয়াত গুলোতে Argue/যুক্তিতর্ক হিসাবে অনুবাদ করেছে।
যেমন
Aal-e-Imran ৩:২০
فَاِنْ حَآجُّوْكَ فَقُلْ اَسْلَمْتُ وَجْهِيَ لِلّٰهِ وَمَنِ اتَّبَعَنِ ؕ وَقُلْ لِّلَّذِيْنَ اُوْتُوا الْكِتٰبَ وَالْاُمِّيّٖنَ ءَاَسْلَمْتُمْ ؕ فَاِنْ اَسْلَمُوْا فَقَدِ اهْتَدَوْا ۚ وَاِنْ تَوَلَّوْا فَاِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلٰغُ ؕ وَاللّٰهُ بَصِيْرٌۢ بِالْعِبَادِ
যদি তারা তোমার সাথে বিতর্কে অবতীর্ণ হয় তবে বলে দাও, “আমি এবং আমার অনুসরণকারীগণ আল্লাহর প্রতি আত্নসমর্পণ করেছি।” আর আহলে কিতাবদের এবং নিরক্ষরদের বলে দাও যে, তোমরাও কি আত্নসমর্পণ করেছ? তখন যদি তারা আত্নসমর্পণ করে, তবে সরল পথ প্রাপ্ত হলো, আর যদি মুখ ঘুরিয়ে নেয়, তাহলে তোমার দায়িত্ব হলো শুধু পৌছে দেয়া। আর আল্লাহর দৃষ্টিতে রয়েছে সকল বান্দা।
আরো অন্যন্য আয়াত দেখা যেতে পারে ;
২ঃ১৩৯, ৩ঃ২০, ৩ঃ৬১, ৩ঃ৬৫, ৩ঃ৬৬, ৩ঃ৭৩, ৬ঃ৮০, ৪২ঃ১৬।
হজ্জ মানে বিতর্ক
কোরআন তারতিল করে , অর্থাৎ কোরআনের অন্য আর যে সব আয়াতে হজ্জ শব্দটি ব্যাবহার হয়েছে , সেখানে হজ্জের কি অর্থ?
হজ্জ শব্দটির মূলে আছে ‘হে জিম জিম’ ‘ح ج ج’ , যার মানে তর্ক/বিতর্ক করা। এখন দেখব কোরআনের কিছু স্পষ্ট আয়াত:
২:১৩৯ قُلْ أَتُحَاجُّونَنَا فِي اللَّهِ وَهُوَ رَبُّنَا وَرَبُّكُمْ وَلَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُخْلِصُونَ
আপনি বলে দিন, তোমরা কি আমাদের সাথে আল্লাহ সম্পর্কে তর্ক (أَتُحَاجُّونَنَا ) করছ? অথচ তিনিই আমাদের পালনকর্তা এবং তোমাদের ও পালনকর্তা। আমাদের জন্যে আমাদের কর্ম তোমাদের জন্যে তোমাদের কর্ম। এবং আমরা তাঁরই প্রতি একনিষ্ঠ।
‘আতুহাজ্জুনানা’ একটি যৌগিক শব্দ , যার মূলে আছে হাজ্জ। হাজ্জের আগে ‘আ’ দিয়ে বাক্যটিকে প্রশ্নবোধক করা হয়েছে। ‘তু’ মানে তোমরা। ‘হাজ্জু’ মানে তর্ক করা। শেষের ‘নানা’ মানে আমাদের সাথে। ‘আতুহাজ্জুনানা’ মানে -” তোমরা কি আমাদের সাথে তর্ক করছ”।
Al-Baqarah ২:২৫৮
اَلَمْ تَرَ اِلَي الَّذِيْ حَآجَّ اِبْرٰهٖمَ فِيْ رَبِّهٖۤ اَنْ اٰتٰىهُ اللّٰهُ الْمُلْكَ ۘ اِذْ قَالَ اِبْرٰهٖمُ رَبِّيَ الَّذِيْ يُحْيٖ وَيُمِيْتُ ۙ قَالَ اَنَا اُحْيٖ وَاُمِيْتُ ؕ قَالَ اِبْرٰهٖمُ فَاِنَّ اللّٰهَ يَاْتِيْ بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَاْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَبُهِتَ الَّذِيْ كَفَرَ ؕ وَاللّٰهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظّٰلِمِيْنَ ۚ
তুমি কি সে লোককে দেখনি, যে পালনকর্তার ব্যাপারে (হাজ্জ)বাদানুবাদ/তর্ক করেছিল ইব্রাহীমের সাথে এ কারণে যে, আল্লাহ সে ব্যক্তিকে রাজ্য দান করেছিলেন? ইব্রাহীম যখন বললেন, আমার পালনকর্তা হলেন তিনি, যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। সে বলল, আমি জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটিয়ে থাকি। ইব্রাহীম বললেন, নিশ্চয়ই তিনি সুর্যকে উদিত করেন পূর্ব দিক থেকে এবার তুমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উদিত কর। তখন সে কাফের হতভম্ব হয়ে গেল। আর আল্লাহ সীমালংঘণকারী সম্প্রদায়কে সরল পথ প্রদর্শন করেন না।
৩:২০…. فَإِنْ حَاجُّوكَ فَقُلْ أَسْلَمْتُ وَجْهِيَ لِلَّهِ وَمَنِ اتَّبَعَنِ
যদি তারা তোমার সাথে বিতর্কে (حَاجُّوكَ)অবতীর্ণ হয় তবে বলে দাও, “আমি এবং আমার অনুসরণকারীগণ আল্লাহর প্রতি আত্নসমর্পণ করেছি।”
‘হাজ্জুকা’ র কা অর্থ তোমার সাথে।
আরো দেখুন – ৩:৬১; ৩:৬৫; ৩:৬৬; ৩:৭৩; ৬:৮০; ৪২:১৬; এই সকল আয়াতে হাজ্জ মানে তর্ক/বিতর্ক। এগুলো সবই স্পষ্ট আয়াত। রূপক আয়াতের হাজ্জ নিয়ে পাথর পুজারীরা ফিতনা ছড়াচ্ছে। স্মরন করুন-
৩:৭ তিনিই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট, সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো রূপক। সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে, তারা অনুসরণ করে ফিৎনা বিস্তার এবং অপব্যাখ্যার উদ্দেশে তন্মধ্যেকার রূপক গুলোর। আর সেগুলোর ব্যাখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর, তারা বলেনঃ আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি। এই সবই আমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। আর বোধশক্তি সম্পন্নেরা ছাড়া অপর কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না।
আবার Noun হিসাবে ব্যবহৃত হজ্বকে তারা নিচের আয়াতগুলোতেও Arguement/যুক্তিতর্ক হিসাবে অনুবাদ করেছে।
২ঃ১৫০, ৪ঃ১৬৫, ৬ঃ৮৩, ৬ঃ১৪৯, ৪২ঃ১৫, ৪২ঃ১৬, ৪৫ঃ২৫।
এটাই যুক্তির ফিল্টারে সবার প্রথমে আটকানোর কথা যে “কোনো ধরনের প্যাগান রিচুয়ালই আল্লাহর একঈশ্বরবাদ/Monotheism বাইত (constitution) এর সাথে যায় না এবং আল্লাহ সেটা আদেশ দিতে পারেন না। কুরবানি, হজ্ব সবই প্যাগান রিচুয়াল।”
১২০০ বছর আগে নরওয়েতে ভাইকিংরাও ছিল প্যাগান এবং তাদেরও একটি পবিত্র স্থান ছিল যেখানে তারা তীর্থযাত্রা করতো এবং সেখানে তারা মানুষ ও পশু কুরবানি দিতো তাদের বিভিন্ন উপাস্যের নামে। শুধু তাই নয়, যেসব মানুষ স্বেচ্ছায় ঐ তীর্থস্থানে বলি/কুরবানি/আত্মত্যাগ করতো সে বিশ্বাস করতে যে সে Valhalla/স্বর্গতে যাবে। Netflix এ ”Viking” সিরিজটা দেখলেও এসব তথ্য জানতে পারবেন।
পার্সিয়ানদের জোরাস্ট্রিয়ান ধর্মও ছিল প্যাগান। একারণে তারা যখন কুরআন নিয়ে খেল তামাশা শুরু করেছিল তখন তাদের অসংখ্য রিচুয়ালও ঢুকিয়ে দিয়েছিল। হজ্ব তাদের মধ্যে অন্যতম।
উপরে যেসব আয়াতের রেফারেন্স দিলাম সেখানে হজ্ব শব্দের অর্থ তীর্থযাত্রা/pilgrimage বসায়ে ভেরিফাই করেন তো যে বাক্যটা যৌক্তিক হয় কি না।
এখন দেখবো তারা কোন্ কোন্ আয়াত নিয়ে খেল তামাশা করে অনুবাদ বিকৃতি করেছে। অর্থাৎ নিচের আয়াত গুলোতে পার্সিয়ান অনুবাদ হিসাবে হ্জ্বকে pilgrimage/ প্যাগান তীর্থযাত্রা হিসাবে অনুবাদ করেছে
আয়াতগুলো হলো ২ঃ১৫৮, ২ঃ১৮৯, ২ঃ১৯৬, ২ঃ১৯৭, ৯ঃ৩, ২২ঃ২৭, ৩ঃ৯৭, ৯ঃ১৯।
অতএব বোঝাই যাচ্ছে কুরআনের অধিকাংশ আয়াতে তারা সঠিক অনুবাদই করেনি, কিছু আয়াতের সঠিক অনুবাদ করেছে। তবে কিছু আয়াতে অনুবাদ বিকৃতি করে তাদের সেই প্যাগান রিচুয়াল ঢুকিয়ে দিয়েছে। কোটি কোটি মানুষ (অধিকাংশই) তা জানেনা।
কুরবানি সংক্রান্ত পর্বের আলোচনায় ২২ঃ৩৪-২২ঃ৩৭ আয়াত গুলোকে আমরা বিশ্লেষণ করব।
হজ্ব শব্দের বিকৃত অনুবাদের আয়াত গুলো নিয়ে বিশ্লেষণ থাকবে পরের পর্ব গুলোতে ইনশাআল্লাহ।
পর্ব ২