তাকওয়া কি?
মুত্তাকি কে?

তাকওয়া কি? মুত্তাকি কে? (১ম পর্ব)

প্রচলিত দৃষ্টিকোণ থেকে তাকওয়া ও মুত্তাকি বিষয়ে সমাজে একটি ধারণা আছে। যাচাই বাছাই ছাড়া সেই ধারণাকেই আকণ্ঠ আঁকড়ে আছে কিতাব-প্রাপ্তরা। বাস্তবতা হলো, প্রচলিত অনেক কিছুর মতোই তাকওয়া/ মুত্তাকির ধারণাতেও রয়েছে বড় ধরনের গলদ।

মূলত কুরআনের শুরুই হয়েছে এই মুত্তাকীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিয়ে। বলা হচ্ছে-

০২. সেই কিতাব- কোনও সন্দেহ নেই তাতে- মুত্তাকিদের জন্য পথনির্দেশ।

(ذٰلِكَ الْكِتٰبُ لَا رَيْبَ ۛ فِيْهِ ۛ هُدًى لِّلْمُتَّقِيْنَۙ ( البقرة: ٢ ))

অতএব কিতাব থেকে পথনির্দেশ বুঝতে হলে প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো- মুত্তাকি (متقي) হতে হবে।

তাহলে, কে সেই মুত্তাকি (متقي)? কিসের ভিত্তিতে একজন মানুষ মুত্তাকি (متقي) হতে পারে? আরবি ভাষার ধারণা এবং মহান রবের দিক-নির্দেশনা থেকেই তা নিশ্চিত হতে হবে। বস্তুত, কিতাব থেকে উপকৃত হতে হলে, দিক-নির্দেশনা পেতে হলে প্রথম ও প্রধান শর্তই হলো ‘মুত্তাকি’ হওয়া। কারণ, মহান রবের কিতাব- هُدًى لِّلْمُتَّقِيْنَ মুত্তাকিনের জন্য হিদায়াত।

বলে রাখা ভালো, অভিধান সূত্রে জানা যায়, শব্দ দুটির ধাতু ওয়া-ক্বাফ-ইয়া (و ق ي); যা দিয়ে তৈরি হয়েছে ৮ ধরনের শব্দ। মহাগ্রন্থে শব্দগুলো এসেছে ২৫৮বার।

1 times as verbal noun tqyaẗ , 2 times as noun atqy, 3 times as active noun waq, 4 times as noun tqy, 16 times as verb wqya, 17 times as noun tqwy, 49 times as form VIII active noun mtqyn, 166 times as form VIII verb atqya

(Surat Al-Baqara – سورة البقرة | Al-Islam.org)

যে ভুল অনুবাদ করা হয়েছে:

প্রচলিত অনুবাদের মৌলিক গলদ ও উদ্দেশ্যমূলক ভুলটি নিম্নরূপ। মহাগ্রন্থে ইত্তাকু/আত্তাকু বা তাকওয়া শব্দের অর্থ পরিবর্তন করা হয়েছে- ‘আল্লাহ’ ও ‘ভয়’ শব্দ ঢুকিয়ে দিয়ে। অথচ, তাকওয়া বা মুত্তাকি শব্দে ‘আল্লাহ’ ও ‘ভয়’ শব্দ দু’টি নাই। উপরন্তু, ভয় বা খিফ (خيف n.) / খাফ (خاف v.) মহাগ্রন্থেই পাওয়া যায়, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে উল্লেখ করা হয়েছে।

সরল বাংলায়, ‘মুত্তাকি’ (متقي) হলেন তিনি, যার ‘তাকওয়া’ (تقوى) আছে।

তাকওয়া (تقوى) কাকে বলে?

তাকওয়া শব্দের অর্থ- সতর্ক/ সচেতনতা বোধ/ be aware of/ conscious থাকা। তাই, সতর্কতা ও সচেতনতা বোধই হলো তাকওয়া (تقوى)।

২:৪৮ তোমরা সে দিবস সম্পর্কে সতর্ক হও (اتَّقُوْ), যেদিন কেউ কারো কোনো উপকারে আসবে না, কারো কাছ থেকে কোন সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না, কারো কাছ থেকে কোনো বিনিময় নেওয়া হবে না এবং তাদেরকে কোনো সাহায্যও করা হবে না।

২:১২৩ তোমরা সে দিবস সম্পর্কে সতর্ক হও (اتَّقُوْ), যেদিন কেউ কারো কোনো উপকারে আসবে না…।

এই সময়টিকে ভয় পাওয়া নয়, বরং সে-সময় সম্পর্কে সজাগ-সচেতন হতেই বলা হচ্ছে। সেখানে আল্লাহকে ভয় পাও- এমনটাও বলা যায় না।

তাহলে মুত্তাকি (متقي)?

যে মানুষ সবসময় সজাগ-সতর্ক থাকে, সচেতন থাকে, যাচাই-বাছাই-পর্যবেক্ষণ না-করে কোনো কিছু গ্রহণ বা বর্জন করে না, জীবন-জগৎ-সংসারে সজাগ-সতর্কতার এই বোধ নিয়ে পথ চলে, তিনিই মুত্তাকি (متقي)। মহান রবের আল-কিতাব থেকে তিনি খুব সহজেই পথনির্দেশনা পেয়ে যাবেন।

পাশাপাশি, যখন বলা হয় ‘তাকওয়া আল্লাহ’ (تقوى الله).. অর্থাৎ আল্লাহর বিষয়ে তাকওয়া.. তখন আল্লাহর বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক হওয়া বা সচেতন থাকার চেষ্টা করতেই বলা হয়েছে। স্রষ্টা-সচেতন হওয়াই ইত্তাকুল্লাহ (وَاتَّقُوا اللّٰهَ) ২:১৮৯, ১৯৪, ২০৩, ২০৬।

২:২০৬ আর যখন তাকে বলা হয়- আল্লাহর বিষয়ে সতর্ক হও (اتَّقِ اللّٰهَ), তখন তার অহমিকা/অহংকার-বোধ তাকে পাপাচারে লিপ্ত করে ( بِالْاِثْمِ); অতএব জাহান্নামই তার জন্য যথেষ্ট এবং নিশ্চয়ই ওটা নিকৃষ্ট আশ্রয়স্থল।

এ অবস্থায় মহাগ্রন্থের শুরুতে যে কথাটি বলা হলো, তার অর্থ হচ্ছে-

আলিফ লাম মিম; সেই কিতাবে কোনো সন্দেহ নেই- ‘সজাগ-সতর্ক–সচেতন মানুষদের’ জন্য পথনির্দেশ।

গোটা মানবজাতির মধ্যে যে কারও টনটনে সজাগ-সতর্ক অনুধাবন শক্তি থাকলেই মহাগ্রন্থে লিপিবদ্ধ বক্তব্য থেকে পথনির্দেশ অনুধাবন করতে পারবে। আর এই বোধটাই হলো মহান আল্লাহর বাণী/ অদৃশ্য জগতের বিষয়াদি সম্পর্কে জানার প্রধান শর্ত।

কুরআন থেকে মুত্তাকির সংজ্ঞা:

এবার খোদ কুরআন থেকেই মুত্তাকির সংজ্ঞা দেখবো।

২:১৭৭ তোমরা তোমাদের লক্ষ্য পূর্ব বা পশ্চিম দিকে ফেরালেও তাতে পুণ্য নেই, বরং পুন্য তার যে আল্লাহ, আখিরাত, মালাইকা, কিতাব ও নবীগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাঁরই প্রেমে ধন-সম্পদের প্রতি আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও সে তা আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন, দরিদ্র, পথিক ও ভিক্ষুকদেরকে এবং দাসত্ব মোচনের জন্য ব্যয় করে, আর সালাত প্রতিষ্ঠিত করে ও পরিশুদ্ধ হয় এবং অঙ্গীকার করলে তা পূরণ করে এবং যারা অভাবে ও ক্লেশে এবং সংকটে ধৈর্যশীল তারাই সত্য পরায়ণ এবং তারাই সজাগ-সচেতন মানুষ।

৩৯:৩৩ আর যে সেই সত্য-সহ (بِٱلصِّدْقِ) এসেছে এবং তাকে সত্য বলেছে/মেনেছে (صَدَّقَ بِهٖٓ)- তারাই হলো সজাগ-সচেতন মানুষ (الْمُتَّقُوْنَ)

জ্ঞানীরা ও চিন্তাভাবনা করতে পারা মানুষরাই যে সজাগ-সতর্ক-সচেতন (মুত্তাকি) হয় সে কথাও বলে দেওয়া হলো:

২:১৭৯ কিসাসের মধ্যে তোমাদের জন্য জীবন রয়েছে, হে বিবেক-বোধ সম্পন্নরা (يّٰٓاُولِى الْاَلْبَابِ)! আশা করা যায় তোমরা সজাগ-সতর্ক-সচেতন হবে (لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ)!

বিবেক-বোধ সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের নিকট আশা করা হচ্ছে যে তারা কিসাস সম্পর্কে জানা-বোঝার মাধ্যমে সচেতন মানুষ হয়ে উঠবে!

কীভাবে এমন সজাগ-সচেতন চিন্তাভাবনা করতে পারা মানুষ তৈরি করা যাবে? তার উত্তরও আছে প্রথম সুরাতেই

২:১৮৩ ওহে যারা ঈমান এনেছ, তোমাদের উপর আস-সিয়াম (الصِّيَامُ) বিধিবদ্ধ (كُتِبَ) করা হল, যেমন বিধিবদ্ধ (كُتِبَ) করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর- সম্ভবত তোমরা সচেতন (تَتَّقُونَ) হবে।

মহান আল্লাহর অজুহাত দিয়ে যথাযথ সঠিক কর্ম থেকেও বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি!

২:২২৪ আর তোমরা আল্লাহকে তোমাদের শপথের বিষয় বানিওনা- সৎকাজ, সচেতনতা অবলম্বন এবং মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপন হতে বিরত থাকার ব্যাপারে; আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞাতা।

যাবতীয় বিষয়ে সবকিছু জানেন ও খোঁজ রাখেন মহান আল্লাহ। সেই মহান রব্বুল আলামিনের বিষয়েই গোঁয়ারতুর্মি করে উদাসীন থাকলে, পরকালে সুনিশ্চিত অন্ধকার! তবে দুনিয়ার বিষয়ে সচেতন থাকার সুবাদে পৃথিবীতে সমৃদ্ধ জীবন পাবে। (২:২০৬ ও ২:২১২)

৩০:৭ তারা জানে দুনিয়ার জীবন থেকে প্রকাশ্য/বাহ্যিক দিক এবং তারা সেই পরজীবন (ٱلْءَاخِرَةِ) সম্পর্কে তারাই উদাসীন/অমনোযোগী (غَٰفِلُونَ)।

২:২০৬ আর যখন তাকে বলা হয়- আল্লাহর বিষয়ে সতর্ক হও (اتَّقِ اللّٰهَ), তখন তার অহমিকা তাকে পাপাচারে লিপ্ত করে ( بِالْاِثْمِ); অতএব জাহান্নামই তার জন্য যথেষ্ট এবং নিশ্চয়ই ওটা নিকৃষ্ট আশ্রয়স্থল।

২:২১২ যারা অবিশ্বাস করে (زُيِّنَ لِلَّذِيْنَ كَفَرُوا) তাদের পার্থিব জীবন সুশোভিত/আকর্ষণীয় (زُيِّنَ) আর তারা উপহাস করে- যারা বিশ্বাস করেছে (الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا) এবং যারা সজাগ-সচেতন (الَّذِيْنَ اتَّقَوْ)- কেয়ামত দিবসে তাদের উপর থাকবে (ا فَوْقَهُمْ) এবং আল্লাহ যাকে চান অপরিমিত রিযিক দেন।

শুধু তা-ই নয়, এমন সজাগ-সচেতন মানুষদের জন্যই মহাগ্রন্থ সহজ ও সুসংবাদ।

১৯:৯৭ অতঃপর প্রকৃত পক্ষে আমি তোমার ভাষায় তা সহজ করেছি যাতে তুমি তা দিয়ে সুসংবাদ দাও (لِتُبَشِّرَ بِهِ) সজাগ-সচেতন লোকদের (ٱلْمُتَّقِينَ) আর তা দিয়ে ঝগড়াটে লোকেদেরকে হুঁশিয়ার/সতর্ক করো (تُنذِرَ)।

২৪:৩৪ আর নিঃসন্দেহে আমি অবতীর্ণ করেছি তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ (وَلَقَدْ اَنْزَلْنَآ اِلَيْكُمْ اٰيٰتٍ مُّبَيِّنٰتٍ) আর তোমাদের পূর্বে যারা অতীত হয়েছে তাদের দৃষ্টান্ত এবং শিক্ষা-সতর্কতা-প্রেরণা (مَوْعِظَةً) সজাগ-সচেতনদের জন্যে (لِّلْمُتَّقِيْنَ)।

কেমনতর সজাগ-সতর্ক-সচেতন মানুষ? কুরআনের শুরু থেকেই কিছু উদাহরণ দেখা যাক:

২:১৮০ তোমাদের ওপর বিধিবদ্ধ হয়েছে (كُتِبَ عَلَيْكُمْ)- যখন তোমাদের কারও মৃত্যু (الْمَوْتُ) হাজির হয়, যদি সে কল্যাণ-সম্পদ (خَيْرًا) ছেড়ে যায়, তবে ন্যায্যভাবে ওসিয়াত করে (ٱلْوَصِيَّةُ–the will) পিতা-মাতা ও নিকট আত্মীয়ের জন্য, সজাগ-সচেতনদের জন্যে এটা যথাযথ কর্তব্য (حَقًّا عَلَى الْمُتَّقِيْن)।

২:২৭৮ ওহে যারা বিশ্বাস করেছ! আল্লাহর বিষয়ে সচেতন হও এবং ছেড়ে দাও যা অবশিষ্ট আছে বর্ধিত সুদ (ٱلرِّبَوٰٓا۟) থেকে- যদি তোমরা বিশ্বাসী হও!

২:২৮১ সে সময়ের (يَوْمًا) বিষয়ে সতর্ক-সচেতন হও (اتَّقُوْا) যে-সময়ের মধ্যে প্রত্যাবর্তন হবে (تُرْجَعُونَ) আল্লাহর দিকে (اِلَى اللّٰهِ); তারপর প্রত্যেক আত্মাকে/ব্যক্তিকে (كُلُّ نَفْسٍ) তার অর্জন পরিপূর্ণ দেওয়া হবে (تُوَفَّىٰ) আর তাদের অন্যায়-অত্যাচার করা হবে না (وَهُمْ لَا يُظْلَمُوْنَ)।

৩:৭৬ হ্যাঁ, যে নিজ তার চুক্তি পূর্ণ করে ও সচেতন থাকে (بَلٰى مَنْ اَوْفٰى بِعَهْدِهٖ وَاتَّقٰى), অতঃপর নিশ্চয়ই আল্লাহ সজাগ-সচেতন লোকদের ভালোবাসেন (فَاِنَّ اللّٰهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِيْنَ)।

৩:১৩৭,১৩৮ নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্বে বহু জীবনাচরণ/পরিস্থিতি (سُنَنٌ) পার হয়েছে, অতএব পৃথিবীতে ভ্রমণ কর (فَسِيْرُوْا فِى الْاَرْضِ) আর খেয়াল করো- মিথ্যাবাদীদের পরিণাম (عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِيْنَ) কেমন হয়েছে। এটা মানবজাতির জন্য বিবরণ (هٰذَا بَيَانٌ لِّلنَّاسِ) ও পথনির্দেশ (هُدًى) এবং শিক্ষা-সতর্কতা-প্রেরণা (مَوْعِظَةً) সজাগ-সচেতনদের জন্যে (لِّلْمُتَّقِيْنَ)।

পৃথিবীতে ভ্রমণ করে তথ্য অনুসন্ধান করা, বিক্ষিপ্ত সূত্র দেখে অতীত রহস্যময় ঘটনা উপলব্ধি করার কাজটি হয়ত রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাসের ফেলুদা বা শার্লক হোমস ভালো পারবে। তবে, বাস্তব জীবনে মানুষই তা পারে। বাস্তবজীবনেই বিচ্ছেদের পর সাবেক স্ত্রীকে যথাযথ ভরণ-পোষণ দেওয়া দুর্বল চেতনার মানুষের কাজ নয়। বরং, যার মধ্যে নিষ্ঠা, সতর্কতা, সচেতনতাবোধ সদা-জাগ্রত থাকে, সেসব মানুষই কঠিন পরিস্থিতিতেও সঠিক কাজ করতে পারে। এমনকি, কতটুকু বিচক্ষণ মানুষ হলে সে তার মৃত্যুর সময় সম্পর্কে ধারণা করতে পারে। তখন সেই মানুষটিকে সহায়-সম্পদ ওসিয়ত করার দায়িত্ব-কর্তব্য দেওয়া হয়েছে (হাক্ব আলা আল-মুত্তাকিন)! তেমন মানুষই তো নিজের প্রতিশ্রুতি/চুক্তি পূর্ণ করার বিষয়ে সদা-সচেষ্ট ও সতর্ক থাকে! টনটনে সচেতন না হলে নিজেকে বিশ্বাসী বলে প্রমাণের জন্য চক্রবৃদ্ধি হারে বর্ধিত রিবার অর্থ ছেড়ে দিতে পারে কেউ?!? আর্থিক লেনদেন, ঋণ-ধারের বিষয়ে ঠিকঠাক লিখে রাখতে বলা হচ্ছে বোকাদের নয়, বরং সজাগ-সচেতন বুদ্ধিমান লোকদেরকেই (২:২৮২,২৮৩)।

এমন মুত্তাকি বা সতত সচেতন ও জাগ্রত চেতনার নারী-পুরুষদের আল্লাহ খুব ভালো করেই জানেন (৩:১১৫); আর তাদেরকেই আসমান-জমিনের পরিধির সমান বিস্তৃত জান্নাতের দিকে ছুটে যেতে বলা হয়েছে (৩:১৩৮)। আল্লাহ মুত্তাকিদের ত্যাগ (৫:২৭) গ্রহণ করেন, তাদেরকেই শুভ পরিণাম দেন (৭:১২৮)। এমন সজাগ-সচেতন মানুষগুলোই মুশরিকদের সঙ্গে চুক্তি সুচারুভাবে রক্ষা করে, যথাযথ ভাবে লড়াই-সংগ্রাম করে (৯:৪,৭,৩৬,৪৪,১২৩), ওহি-সূত্রে প্রাপ্ত গায়েবের জগতের বিষয়ে সবর অবলম্বন করে (১১:৪৯), তারা জগতেও কল্যাণ করবে, কল্যাণপ্রাপ্ত হবে; তাদের আখিরাতের আবাসও হবে উৎকৃষ্ট মানের (১৬:৩০,৩১)। এমন সজাগ-সচেতন মানুষ হবে মহান আল্লাহর কাছে সম্মানিত (১৯:৫৮, ৩৮:৪৯); আর মহান আল্লাহই মুত্তাকিদের পক্ষে থাকেন, তাদের রক্ষা করেন (৪৫:১৯)।

পরিশেষে, ৩:১০২ ওহে যারা বিশ্বাস করেছো! আল্লাহ সম্পর্কে সচেতন হও (اتَّقُوا اللّٰهَ) যেভাবে তাঁর প্রতি যথাযথ সচেতন হতে হয় (حَقَّ تُقٰىتِهٖ); আর তোমরা আত্মসমর্পণকারী (اَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ) না হয়ে মারা যেও না!

মুত্তাকি কে, কারা (২য় পর্ব)

যেসব মানুষ সব সময় সজাগ-সচেতন থাকে, যাচাই-বাছাই-পর্যবেক্ষণ না-করে কোনো কিছু গ্রহণ বা বর্জন করে না, জীবন-জগৎ-সংসারে সজাগ-সতর্কতার বোধ নিয়ে পথ চলে, তিনিই মুত্তাকি (متقي)। মহান রবের আল-কিতাব থেকে তিনি খুব সহজেই পথনির্দেশনা পেয়ে যাবেন।

পাশাপাশি, যখন বলা হয় ‘তাকওয়া আল্লাহ’ (تقوى الله)…

অর্থাৎ আল্লাহর বিষয়ে তাকওয়া.. তখন আল্লাহর বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক হওয়া বা সচেতন থাকার চেষ্টা করতেই বলা হয়েছে। স্রষ্টা-সচেতন হওয়াই ইত্তাকুল্লাহ (وَاتَّقُوا اللّٰهَ) ২:১৮৯, ১৯৪, ২০৩, ২০৬।

এবার দেখা যাক- যেখানে ‘ইত্তাকু’ ও ‘খওফ’ শব্দদ্বয় একসঙ্গে আছে। অর্থাৎ, সতর্কতা-সচেতনতা ও ভয় একসঙ্গে আছে।

এই আয়াতটি ইত্তাকু ও খওফ-কে আলাদা করে দেয়। কারণ, কিতাবে একই অর্থ প্রকাশে ভিন্ন দুটি শব্দ কখনও ব্যবহার করা হয়নি। প্রতিটি শব্দ, অক্ষর, চিহ্নের সুস্পষ্ট আলাদা অর্থ রয়েছে। অর্থাৎ, মহাগ্রন্থে কোনো প্রতিশব্দ বা synonym নাই।

অর্থাৎ, সুস্পষ্টভাবে ‘খওফ’ অর্থ ভয়। তাহলে কোনোভাবেই ইত্তাক অর্থ ‘ভয়’ হতে পারবে না। আল্লাহর শব্দভাণ্ডারের অভাব পড়েনি নিশ্চয়ই।

৭:৩৫ হে আদমের বংশধর! তোমাদের কাছে তোমাদেরই মধ্যে থেকে যখন রসুলগণ আসে- যারা তোমাদের কাছে আমার আয়াত/নিদর্শনগুলো ব্যাখ্যা করে (يَقُصُّونَ), তখন যারা সজাগ-সতর্ক-সচেতন হবে (فَمَنِ اتَّقٰى) করে আর সংস্কার-সংশোধন করবে (وَأَصْلَحَ); অতঃপর তাদের জন্য কোন ভয় নেই (فَلَا خَوْفٌ), তারা দুঃখিত/চিন্তিত হবে না (وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ)।

ভয়/আশঙ্কা/দুশ্চিন্তা বা ‘খওফ’ সংক্রান্ত আরো আয়াত: ২:৩৮, ৬২, ১১২, ১৫৫, ২৬২, ২৭৪, ২৭৭; ৩:১৭০; ৪:৮৩, ৫:৬৯, ৬:৪৮, ৭:৩৫, ৪৯, ৫৬; ১০:৬২, ৮৩; ১৩:১২, ১৬:১১২, ২৪:৫৫, ৩০:২৪, ৩২:১৬, ৩৩:১৯, ৪৩:৬৮, ৪৬:১৩, ১০৬:৪

এসব আয়াতের কোথাও আছে- বিদ্যুৎচমকের ভয়, ক্ষুধার কষ্টে পড়ার ভয়, দুর্যোগের ভয়…; যা মূলত দুঃখ-কষ্ট-আশঙ্কার ভয়।

পাশাপাশি, যারা সজাগ-সচেতন মানুষ (মুত্তাকি), তারা দুনিয়ার জীবনের এহেন সংকট ও শঙ্কা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে পারেন। আর যারা একই সঙ্গে সজাগ-সচেতন (মুত্তাকি) এবং মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী (আমানু-মু’মিন) তারা দুনিয়ার জীবন এবং আল-আখিরাতের কঠিন বিপদ-ভয়-আশঙ্কা থেকে রক্ষা পেতে পারেন।

আর তার পরিণাম হিসেবে সজাগ-সচেতন মানুষগুলো (الْمُتَّقِيْنَ) পাবে অফুরন্ত পুরস্কার- যা মহান আল্লাহর অফুরান দয়ার অংশমাত্র।

যেমন-

নিশ্চয়ই সজাগ-সচেতন মানুষগুলো (الْمُتَّقِيْنَ) থাকবে উদ্যান ও নির্ঝরিনীর মধ্যে (اِنَّ الْمُتَّقِيْنَ فِيْ جَنّٰتٍ وَّعُيُوْنٍ) ১৫:৪৫

নিশ্চয়ই সজাগ সচেতন মানুষগুলো (الْمُتَّقِيْنَ) প্রাচুর্যের উদ্যানে (جَنّٰتٍ وَّنَعِيْمٍ)। (৫২:১৭)
اِنَّ الْمُتَّقِيْنَ فِيْ جَنّٰتٍ وَّنَعِيْمٍۙ ( الطور: ١٧ )

সেসময় (يَوْمَ) সজাগ-সচেতন মানুষগুলোকে সমবেত করবো আর-রহমানের কাছে প্রতিনিধি-স্বরূপ (وَفْدًا —delegations)। ১৯:৮৫

এই হলো যিকর-উপদেশ (هٰذَا ذِكْرٌ); আর নিশ্চয়ই সজাগ-সচেতন মানুষদের জন্য (لِلْمُتَّقِيْنَ) সুনিশ্চিত উৎকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল (لَحُسْنَ مَاٰبٍ)। ৩৮:৪৯

নিশ্চয়ই সজাগ-সচেতনরা (الْمُتَّقِيْنَ) নিরাপদ স্থানে (مَقَامٍ اَمِيْنٍ)। ৪৪:৫১

[اِنَّ الْمُتَّقِيْنَ فِيْ مَقَامٍ اَمِيْنٍۙ ( الدخان: ٥١ )]

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ‘তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার সতর্ক-সচেতন মানুষ’ মানুষ কিন্তু অবিশ্বাসী বা স্রষ্টার বিষয়ে (স্বেচ্ছায়) অসচেতন বা অস্বীকারকারীও হতে পারে।

যেমন, বর্তমান বিশ্বের চরমপন্থি ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রগুলোর প্রধান যারা, সেসব শাসক গোষ্ঠীর লোকজন খুব ভালো করেই জানে যে, কীভাবে মানুষের ওপর শোষণ বঞ্চনা চালাতে হয়। যেমন ধরুন, উত্তর কোরিয়া, চীন, ইরান এমনসব দেশের শাসকগোষ্ঠী শত বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্মের মানুষকে বুদ্ধি, শক্তি, মেধা, অর্থ, অস্ত্র দিয়ে অন্ধ বানিয়ে রেখেছে। তারা কি নিরেট বোকা টাইপের মানুষ হতে পারে? অবশ্যই না। বরং, তারা প্রচণ্ড চতুর, কৌশলী, জাগতিক শিক্ষায় উন্নীত বুদ্ধিমান মানুষ। রাজনীতি, শাসননীতি ও সংশ্লিষ্ট খাতে তারা ‘তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাসম্পন্ন সচেতন মানুষের’ কাতারেই পড়েন। তাহলে তারাও কি মুত্তাকী হয়ে যায় না? তারাও কি মুত্তাকি হওয়ার জন্য মহান রবের কাছে ‘মাগফিরাত ওয়া জান্নাত’ পেয়ে যাবে?

সাধারণ বিচারবোধ বলে, তেমনটি হবার কথা নয়। অথবা, মুত্তাকি সনাক্তকরণে কোথাও ভুল হয়েছে।

আসলে, মুত্তাকি’র সংজ্ঞা ঠিকই আছে। তবে, জান্নাত ও মাগফিরাত লাভের শর্তে খেয়াল না-করার কারণে। আর তা হলো, মুত্তাকি ব্যক্তিকে মহান স্রষ্টার বিষয়ে ঈমান বা বিশ্বাস আনতে হবে। আর সত্য সঠিক বিশ্বাসের ভিত্তিতেই মুত্তাকি মানুষ জুলুম-নির্যাতন-অন্যায়ের পথ থেকে ফিরে আসবে।

২:১০৩ আর যদি তারা বিশ্বাস করতো (اٰمَنُوْا) এবং সজাগ-সচেতন হতো (وَاتَّقَوْا) আল্লাহর নিকট থেকে সুনিশ্চিত কল্যাণকর (خَيْرٌ) পুরস্কার পেত।

০৫:০৮ ওহে যারা ঈমান এনেছো (يٰٓاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا)! আল্লাহর জন্য ন্যায্যভাবে (بِالْقِسْطِ) সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকো (قَوَّامِيْنَ لِلّٰهِ شُهَدَاۤءَ); আর বিদ্বেষ তোমাদের প্ররোচিত না করে (وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَاٰنُ) কোন জাতি/গোষ্ঠী/ সম্প্রদায়ের প্রতি (قَوْمٍ عَلٰٓى) যাতে তোমরা সুবিচার না করো (اَلَّا تَعْدِلُوْا); তোমরা সুবিচার কর (اِعْدِلُوْاۗ هُوَ)- তা সচেতনতার নিকটতর (اَقْرَبُ لِلتَّقْوٰىۖ); আর আল্লাহ-সচেতন হও (وَاتَّقُوا اللّٰهَ); নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালোভাবেই অবহিত- তোমরা যা করো।

০৫:১১ ওহে যারা ঈমান এনেছো ( اٰمَنُوا)! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর (اذْكُرُوْا نِعْمَتَ اللّٰهِ) যখন এক সম্প্রদায় তোমাদের দিকে হাত বাড়াতে চেয়েছিল তখন তিনি তাদের হাত তোমাদের থেকে নিবৃত্ত করেছিলেন; আর তোমরা আল্লাহ সচেতন হও (وَاتَّقُوا اللّٰهَ); আল্লাহর উপরেই মুমিনদের নির্ভর করা উচিত (وَعَلَى اللّٰهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ)।

০৫:৫৭ ওহে যারা ঈমান এনেছো (يٰٓاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا)! গ্রহণ করো না- যারা তোমাদের দীন/জীবন ব্যবস্থা-কে তামাশা ও খেলার বিষয় রূপে ( هُزُوًا وَّلَعِبًا) গ্রহণ করে- যাদেরকে তোমাদের পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে থেকে ও কাফেরদেরকে অভিভাবক-রূপে (أَوْلِيَآءَۚ); আর আল্লাহ সচেতন হও (وَاتَّقُوا اللّٰ) যদি তোমরা বিশ্বাসী (مُّؤْمِنِينَ) হও।

৫:৬৫ আর যদি আল-কিতাবের অধিকারীরা বিশ্বাস করতো ও সজাগ-সচেতন হতো (اٰمَنُوْا وَاتَّقَوْ) অবশ্যই মুছে দিতাম (لَكَفَّرْنَا) তাদের থেকে তাদের দোষগুলো এবং আমি তাদের প্রবেশ করাতাম সেই সমৃদ্ধির উদ্যানে (جَنّٰتِ النَّعِيْمِ)।

৭:৯৬ জনপদের অধিবাসীরা যদি বিশ্বাস করতো ও সজাগ-সচেতন হতো (اٰمَنُوْا وَاتَّقَوْا) তাহলে আমি তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর বরকতের দ্বারসমূহ (بَرَكٰتٍ مِّنَ السَّمَاۤءِ وَالْاَرْضِ) খুলে দিতাম, কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, অতঃপর তাদেরকে পাকড়াও করলাম তাদের কৃতকর্মের কারণে।

১২:৫৭ তাদের জন্য সেই পরজীবনের (الْاٰخِرَةِ ) পুরস্কারই উত্তম- যারা বিশ্বাস করে (لِّلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا) এবং তারা সজাগ-সচেতন থাকে (وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ)।

১৬:৩০ আর যারা সজাগ-সচেতন ছিল তাদেরকে বলা হবে তোমাদের রব কি নাযিল করেছিলেন? তারা বলবে- কল্যাণ; যারা এই দুনিয়ায় ভালো করবে তাদের জন্য ভালোই আর আখিরাতের বাসস্থান কল্যাণময়; আর সজাগ-সচেতন মানুষের আবাস সুনিশ্চিত চমৎকার।

৪৯:১ ওহে যারা বিশ্বাস করো (ءَامَنُوا۟)! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের সামনে অগ্রগামী হয়ো না আর আল্লাহ সচেতন হও (وَاتَّقُوا اللّٰهَ ); নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞানী (سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ )।

৪৭:৩৬ নিশ্চয়ই দুনিয়ার জীবন (الْحَيٰوةُ الدُّنْيَا) খেলা ও অর্থহীন আনন্দের (لَعِبٌ وَّلَهْوٌ); আর যদি তোমরা বিশ্বাস করো ও সজাগ-সচেতন হও (تُؤْمِنُوْا وَتَتَّقُوْا), তিনি তোমাদের পুরস্কার দেবেন (يُؤْتِكُمْ اُجُوْرَكُمْ), আর তিনি তোমাদের সম্পদ চান না (وَلَا يَسْـَٔلْكُمْ اَمْوَالَكُمْ)।

প্রচলিত একাধিক অভিধান থেকেও দেখা যায়,

পরিশেষে-

৬:৩২ এই দুনিয়ার জীবন (الْحَيٰوةُ الدُّنْيَآ) শুধুমাত্র খেলা ও অর্থহীন আনন্দের (اِلَّا لَعِبٌ وَّلَهْوٌ) এবং পরজীবনের সেই বাসস্থান উৎকৃষ্ট- তাদের জন্য যারা সজাগ-সতর্ক-সচেতন (لِّلَّذِيْنَ يَتَّقُوْنَ); তাহলে কি যুক্তি-বোধ খাটাবে না (اَفَلَا تَعْقِلُوْنَ)?

৩:১৩৮ এটা বর্ণনা (بَيَانٌ) মানবজাতির জন্য (لِّلنَّاسِ) এবং দিক-নির্দেশনা ও বিশেষ উপদেশ (মাওইজাতুন- مَوْعِظَةٌ) সজাগ-সচেতনদের জন্য (لِّلْمُتَّقِيْنَ)।

৬:১৫৫ আর এই গ্রন্থ (وَهٰذَا كِتٰبٌ) আমি তা নাযিল করেছি (اَنْزَلْنٰهُ) কল্যাণময় (مُبٰرَكٌ); অতএব তারই অনুসরণ করো (فَٱتَّبِعُوهُ) এবং সজাগ-সচেতন হও, যাতে তোমরা দয়া লাভ করো (لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ)।

সিয়াম-

كتب কুতিবা

বিস্তারিত বিশ্লেষণ:

সিয়াম , কুতিবা

কুতিবা (كُتِبَ): ‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর’ মতো ‘কিতাব-খুঁড়ে সিয়াম খোঁজা’ শুরু করেছি আমরা। সে ধারাবাহিকতায় ‘সিয়াম’ (الصِّيَامُ) সম্পর্কে জানার ও বোঝার চেষ্টা করবো।
তবে সিয়াম সম্পর্কে জানতে হলে সবার আগে কুতিবা (كُتِبَ) সম্পর্কে জানা জরুরি। কারণ, আস-সিয়াম তো কুতিবা হয়েছে! তাই কুতিবা সম্পর্কে না জানলে- সিয়াম সম্পর্কেও জানা-বোঝা যাবে না।
যেমন ধরুন, ‘ভেজিটেবল কুক’ করতে বলা হলো। যার উদ্দেশ্য খেয়েদেয়ে স্বাস্থ্য ভালো রাখা। তবে আপনাকে জানানো হলো কুক/ cook অর্থ- রোদে শুকানো(!); আর ভজিটেবল/ vegetable অর্থ জামাকাপড়(!) (অভিধানেও তা লেখা হলো)। এবার অবধারিতভাবে আপনি ধরে নেবেন ‘ভেজিটেবল কুক করা’ মানে জামা কাপড় ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করে রোদে শুকিয়ে গায়ে দেওয়া। যাতে শরীর-মন উন্নত হয়। তাইনা ?
তাই, সিয়াম শব্দ বোঝার আগে আমরা কুতিবা (كُتِبَ) শব্দের অর্থ সুনির্দিষ্ট দলিল সহ বুঝবো। অভিধান ও প্রচলিত অনুবাদ আমাদের জন্য রেফারেন্স মাত্র; কিন্তু পথনির্দেশক হলো আল কুরআন । চলুন শুরু করা যাক।
কুরআনে ‘সিয়াম (الصِّيَامُ)’ সম্পর্কে আল্লাহর প্রথম বক্তব্যটি হলো- ‘কুতিবা আলাইকুম আস-সিয়াম’ (كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ) যার প্রচলিত অনুবাদ হলো ‘তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে’!
কী বিস্ময়কর মিথ্যাচার ও জালিয়াতি অনুবাদ!
কেন জালিয়াতি অনুবাদ?

কুতিবা: ফরজ করা হয়েছে; আলাই-কুম: তোমাদের ওপর; সিয়াম: রোজা !!!

শুধুমাত্র, আলাই-কুম বা ‘তোমাদের ওপর’ এই অংশের অনুবাদটাই ঠিক আছে। বাকি দু’টি শব্দ ইচ্ছা করে পরিবর্তন করা হয়েছে।
বাকি ২টা শব্দ ঠিক নেই! এ দাবির প্রমাণ কি??
প্রমাণ হলো খোদ কুরআন , অর্থাৎ আল্লাহর কথা!
যেমন, রুব্বুল আলামিন নিজেই বলেছেন- আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরজ বা ফারিদাতুম মিনাল্লাহ (فَرِيْضَةً مِّنَ اللّٰهِ)। দেখা যাচ্ছে, ফরজ (فرض) শব্দটি মহান আল্লাহ জানেন এবং যেখানে বলা প্রয়োজন সেখানেই তিনি বলেছেন! নাকি ভিন্ন কিছু ভাবছেন ?!? (ফরজ/নির্ধারণ দেখুন এখানে ৪:৭,১১; ৯:৬০; ২৪:১; ২৮:৮৫, ৩৩:৩৮,৫০)।

কিন্তু সয়ামের সঙ্গে তিনি ফারদ/ফরজ বলেন নি(!) বরং, কুতিবা বলেছেন। একটা কুর’আনিক আরবি শব্দ ‘কুতিবা’ (كُتِبَ) অর্থ আরেকটা কুর’আনিক আরবি শব্দ ‘ফরজ’ (فرض) হতে পারে? ‘আম’ অর্থ কখনও ‘কলা’ হয়? হতে পারে? অবশ্যই না!
ঠিক তেমনি- সিয়াম অর্থ রোজা, উপবাস, সকাল সন্ধ্যা না খেয়ে থাকা লেখা হয়েছে। যা জোর করে আরোপিত অনুবাদ। সিয়ামের তদন্তে যাবার আগে কুতিবা (كُتِبَ) জেনে নেওয়া যাক।
কুতিবা (كُتِبَ) মানে কি? যেহেতু সিয়াম কুতিবা (করা হয়েছে), সেহেতু কুতিবা না বুঝলে কোনোভাবেই ‘সিয়াম’ জানা, বোঝা বা উপলব্ধি করা যাবে না।
কুতিবা (ধাতু: কাফ-তা-বা) শব্দটি মহাগ্রন্থে এসেছে মাত্র ১১বার। এই ১১টা আয়াত পড়ুলে ও বুঝলেই আমরা জানতে পারবো ‘কুতিবা’ (كُتِبَ) দিয়ে কি বোঝানো হয়েছে। আর এই ১১বারের মধ্যে সাতবারই ২নং সুরাতে! (২:১৭৮, ১৮০, ১৮৩, ২১৬, ২৪৬; ৩:১৫৪; ৪:৭৭, ১২৭; ৯:১২০, ১২১ এবং ২২:৪)
সবগুলো আয়াত বিশ্লেষণ করা সময় স্বাপেক্ষ কাজ। তাই দ্রুত বোঝার সুবিধার্থে আমরা ২:২৪৬ এবং ৩:১৫৪ বাক্যটি দেখবো।
প্রচলিত অনুবাদ: অতঃপর কষ্টের পর আল্লাহ তোমাদের প্রতি শান্তি-তন্দ্রা প্রেরণ করলেন, যা তোমাদের একদলকে আচ্ছন্ন করল এবং অন্যদল মূর্খের মতো আল্লাহর প্রতি কুধারণা পোষণ করতঃ নিজেরাই নিজেদের জীবনকে উদ্বেগাকুল করে বলল, কাজ-কর্মের ব্যাপারে (সিদ্ধান্ত গ্রহণের) আমাদের কিছুমাত্র অধিকার আছে কি? বল, ‘সমস্তই আল্লাহর নিরঙ্কুশ অধিকারভুক্ত’। তারা এমন সব কথা অন্তরে পোষণ করে- যা তোমার কাছে প্রকাশ করে না। তারা বলে, ‘যদি মতামত প্রদানের অধিকার আমাদের কিছুমাত্রও থাকত, তাহলে আমরা এ স্থলে নিহত/ অপমানিত/হতাশ হতাম না’। বলে দাও, ‘যদি তোমরা তোমাদের ঘরেও থাকতে, তথাপি যাদের ভাগ্যে মৃত্যু/হতাশা/অপমান লেখা ছিল, তারা তাদের এ মৃত্যু শয্যার পানে/অপমানিত হওয়ার জন্য / বের হয়ে পড়ত’। এবং এজন্যও যে আল্লাহ তোমাদের অন্তরের ভেতরের বিষয় গুলো পরীক্ষা করেন এবং তোমাদের অন্তরস্থ বিষয় গুলোকে পরিষ্কার করেন, বস্তুতঃ আল্লাহ সকলের অন্তরের কথা সম্পর্কে বিশেষভাবে অবহিত।
৩:১৫৪ এর শেষ দিকে বলা হলো-
যদি আমাদের কোনো কিছুর বিষয়ে এখতিয়ার থাকতো- আমরা (আমাদের লোকেরা) এখানে নিহত /অপমানিত/হতাশাগ্রস্থ হতাম না (!)
বলে দাও- যদি তোমরা তোমাদের ঘরের মধ্যেও থাকতে, অবশ্যই বের হতো তারা- যাদের ওপর নিহত হওয়ার/মারা যাবার/অপমানিত হওয়ার ‘কুতিবা হয়েছে’ (আল-ক্বতলু কুতিবা) তাদের নিহত হবার /অপমানিত হওয়ার স্থানের দিকে…
এখানে কুতিবা অর্থ- ‘লিখে দেওয়া হয়েছে’ ধরলে, প্রমাণ হয় যে, মহান আল্লাহ মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেন ও তকদির লিখে দেন ! অর্থাৎ, মানুষের চেষ্টা-কর্ম-চিন্তা-উদ্যোগের কোনো মূল্যই নাই! এই অর্থ বিশ্বাস করলে সম্পূর্ণ একটি মহাগ্রন্থ নাযিল করা, মানুষের চিন্তা বিবেক জাগ্রত করে সঠিক পথে চলতে বলা, অন্যায়-অত্যাচার-মিথ্যাচার মোকাবিলা করতে বলা, সর্বশক্তি দিয়ে ন্যায় ইনসাফ কায়েম করতে বলা, সালাত-যাকাতের জন্য বলা এবং সৎকর্মশীলদের ভালো কাজ করতে বলা— সবই অর্থহীন হয়ে যায়। নিশ্চয়ই তা আমরা বুঝতে পারেছি!
অথচ বাস্তবতা হলো, আল্লাহ মানুষকে কোনো কাজের জন্যই বাধ্য করেন না, এজন্যই মানুষের স্বেচ্ছায় করা ভালো বা মন্দ কাজের জন্য পুরস্কার বা শাস্তি দেবেন তিনি। স্বাধীনতার এই ক্ষমতা বা শক্তি (ইবাদত) দেওয়া হয়েছে মানুষ ও জিনকে। এই দুই সৃষ্টি- স্বাধীন শক্তির কারণেই কর্মের প্রতিদান পাবে। আর কোনোকিছুই স্বাধীন নয়। তাদের/সেসবের কোনো প্রতিদান নেই। এ বিষয়টি বুঝতে পারেন আপনি? চিন্তাশক্তি-যুক্তিবোধ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করুন।
কুতিবা (كُتِبَ) অর্থ- ‘লিখে দেওয়া হয়েছে(!)’ এমন মিথ্যাচার করে গোটা পৃথিবীকে মহাসত্য থেকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে! আল্লাহর নাম নিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দলে দলে লোক মুশরিকে পরিণত হয়ে অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেছে!
অধিকাংশ মানুষ আল্লাহতে বিশ্বাস করে, কিন্তু সেই সঙ্গে শিরকও করে। {১২:১০৬}
কিতাবধারীদের মধ্যে যারা কুফুরি করে তারা- আর মুশরিকরা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে। এরাই সৃষ্টির অধম। {৯৮:৬}
আর তাদের বেশিরভাগ অনুমান/ধারণা (ظَنًّاۗ) ছাড়া অনুসরণ করে (يَتَّبِعُ) না; নিশ্চয়ই সত্যের (ٱلْحَقِّ) ক্ষেত্রে অনুমান/ধারণা (ٱلظَّنَّ) কোনো কাজ করে না…{১০:৩৬}
যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার অনুসরণ করো না…{১৭:৩৬}
যারা মনোযোগ দিয়ে কথা শোনে এবং তাতে যা উত্তম তা গ্রহণ করে। এরাই সেসব লোক, যাদের আল্লাহ্‌ হিদায়াত করেছেন এবং তারাই বুদ্ধিমান লোক। {৩৯:১৮}
জলদি বলুন ‘কুতিবা’ অর্থ কি?
কুতিবা (كُتِبَ) অর্থ সেটাই, যা ৩:১৫৪ আয়াতে বসবে এবং অন্য ১০টি আয়াতেও যথাযথ অর্থপূর্ণ বক্তব্য দেবে। আর তা হলো-

“জোরালো নির্দেশনা/তাড়না/প্রেরণা/উৎসাহ দেওয়া’; এবং ওই কথাটির অপেক্ষাকৃত সঠিক অনুবাদ হলো- যদি আমাদের কোনো কিছুর বিষয়ে এখতিয়ার থাকতো- আমরা এখানে নিহত/অপমানিত হতাম না;
বলে দাও- যদি তোমরা তোমাদের ঘরের মধ্যেও থাকতে, অবশ্যই বের হয়ে যেত তাদের নিহত/অপমানিত হবার স্থানে- যাদের ওপর নিহত হওয়ার/মৃত্যুকে বরণ করার/অপমানিত হওয়ার ‘জোরালো প্রেরণা উৎসাহ দেওয়া হয়েছে’ (আল-ক্বতলু কুতিবা)…
অর্থাৎ, কুতিবা শব্দটির ব্যাখ্যামূলক অর্থ হলো- জোরালো তাড়না-প্রেরণা-উৎসাহ-নির্দেশনা দেওয়া।
এই শক্তিশালী তাড়না-প্রেরণা-নির্দেশনার মাত্রা মহান আল্লাহই ঠিক করে দেন বলেই বোঝা যাচ্ছে। কারণ, এই প্রেরণা পাওয়ার পরও মানুষের নফস তা অস্বীকার করতে পারে! এবং সে কথাও বলা হয়েছে ২:২৪৬ এর শেষাংশে:
তারপর যখন তাদের উপর সংগ্রাম/লড়াই/যুদ্ধ কুতিবা হলো (তাদের হৃদয়ে লড়াইয়ের জন্য শক্তিশালী নির্দেশনা/প্রেরণা দেওয়া হলো), তখন তাদের অল্প কিছু লোক ছাড়া বাকি সবাই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলো; আল্লাহ যালিমদের অবস্থা বিশেষভাবে অবহিত।
ঠিক এভাবেই ৩:১৫৪ আয়াতে মানুষের অন্তর-মনের বিষয়েই কথা হচ্ছে। যা গোপন করা হয়, যা প্রকাশ করে মানুষ। শেষ দিকে বলা হয়েছে- “এর কারণ হলো, আল্লাহ তোমাদের মনে যা আছে তা পরীক্ষা করতে চান এবং তোমাদের সংশোধন ও পরিশুদ্ধ করতে চান। আল্লাহ অন্তরের খবর বিশেষভাবে জানেন।
খেয়াল রাখুন- মানবদেহের মধ্যে যে নফস দেওয়া হয়েছে- তাই মূলত আমি/আপনি। এই প্রকৃত ‘আমি’ কি সিদ্ধান্ত নিই- সেই পরীক্ষাগার এই বাস্তব পৃথিবী। পাশাপাশি, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে- সেই আমি/আপনি/নফস পরিশুদ্ধ হয়। নয়তো সে জালিম হয়।
৩:১৫৪ এর শেষ কথাটা হলো “বলে দাও- যদি তোমরা তোমাদের ঘরের মধ্যেও থাকতে, যাদের ওপর নিহত হওয়ার/মৃত্যুকে বরণ করার /অপমানিত হওয়ার “শক্তিশালী নির্দেশনা/প্রেরণা দেওয়া হয়েছে”- অবশ্যই তারা বের হয়ে যেত- তাদের নিহত/অপমানিত হবার স্থানের দিকে…”
এবার কিতাব দিয়ে আরেকবার যাচাই করুন। দেখুন বাকি ৮টি কুতিবা।
২:১৭৮এ কুতিবা আলাইকুম কিসাস..। অর্থাৎ, হত্যার বদলে হত্যার ‘জোরালো নির্দেশনা-প্রেরণা দেওয়া হয়েছে’। গভীর জঙ্গলেও হত্যার প্রতিশোধের উন্মত্ত তাড়নায় মেতে ওঠে শিক্ষা-দীক্ষা বর্জিত মানুষগুলো!
২:১৮০তে কুতিবা আলাইকুম…আল-ওসিয়াত। উন্নত দেশগুলো দেখুন। সচেতন মানুষগুলো মৃত্যুর আগেই তাদের সম্পদ ‘উইল/ওসিয়াত’ করে যায় নিকটজন ও অভাবীদের জন্য। এই প্রেরণা তাদেরকেও দেওয়া হয়েছে। বাংলার দানবীর হাজী মুহাম্মদ মহসিনের নাম কে না জানে! মৃত্যুর ৬ বছর আগে ১৮০৬ সালে তিনি পুরো সম্পত্তি মানবকল্যাণে ওয়াকফ করে যান।
২:২১৬তে কুতিবা আলাইকুম আল-কিতালু। যদিও বেশিরভাগ মানুষ লড়াই-সংঘাত-সংঘর্ষ-যুদ্ধ অপছন্দ করে। কিন্তু বাস্তব প্রয়োজনে- সেই প্রাচীন গুহা-গোত্রের যুগ থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে অনিবার্যভাবে যুদ্ধ-সংগ্রাম-লড়াইয়ে জড়ায় মানুষ। যুদ্ধের নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে তরুণ-যুব সমাজ। সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার মহান এই মৃত্যুক্ষুধা- কোথা থেকে পেল শান্তিপ্রিয় মানুষ!
৪:৭৭এও আল-কিতাল সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং মানুষের মনস্তাত্ত্বিক চরিত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
৪:১২৭এ অর্থ-লোভে এতিমদের মেয়েদের বিয়ে করে তাদের সম্পদ থেকে বঞ্চিত না-করার বিষয়টি মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই নির্দেশনা ও প্রেরণা কথা আল-কিতাবেও উল্লেখ করা হয়েছে যা কিতাব-ধারীরা পড়ে ও জানে বলেই উল্লেখ করা হয়েছে! এটাই কুতিবা। মানুষকে যথাযথ তথ্য দেওয়া।
৯:১২০ একটি বড় আয়াত। কুতিবা অংশটুকুর অনুবাদের ভুল সংশোধন করলে যা দাঁড়ায় তা হলো:

সেটা এজন্য যে, আল্লাহর পথে তাদের তৃষ্ণা, ক্লান্তি ও ক্ষুধার কষ্ট হয় এবং তাদের পদক্ষেপে কাফিরদের ক্রোধ হয় এবং শত্রুদের ক্ষতি হয়- শুধুমাত্র এজন্য যে তাদের জোরালো তাড়না-উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দেওয়া হয়েছে সৎকর্মে (আমলে সলিহা)…।
২২:৩,৪ থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ সম্পর্কে মূর্খ ও অজ্ঞের মতো যে কথাবার্তা বলে, সেও জোরালো উৎসাহ-তাড়না-প্রেরণা পাবে। কি সেই প্রেরণা? তা হলো, যেসব মানুষ তাদেরকে অভিভাবক ও বন্ধু বানাবে, মূর্খ ও অজ্ঞ গুলো তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে জ্বলন্ত শাস্তির শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাবে।
তাহলে, কুতিবা শব্দটির প্রকৃত ব্যাখ্যামূলক অর্থ হলো: শক্তিশালী তাড়না-প্রেরণা-নির্দেশনা দেওয়া। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে জোরালো প্রেরণা!
এখনও পৃথিবীতে উপরোক্ত বিষয়ে মানুষকে কুতিবা (জোরালো তাড়না-প্রেরণা) দেওয়া হচ্ছে! হরহামেশা সেই কুতিবা হচ্ছে।
সহস্র বছর ধরে লক্ষ কোটি বনি-আদম অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকেও মাথা পেতে নেয়। কেন? কে দেয় সে অন্যায় মোকাবিলার প্রেরণা….? কে দেয় মৃত্যুকে বরণ করার তাড়না?
সেটাই হলো- কুতিবা (كُتِبَ) আলাইহিম- তাদের ওপর কুতিবা।

সিয়াম

সুরা ক্বদরের

অনুবাদ:

১) নিশ্চয়ই আমরা এটিকে নাজিল করেছি ( ইন্না আনজালনা হু ফি) অন্ধকারের (লাইলাতুল) মহাশক্তিময় যুগে (ক্বদর, ক্বাদিরুন অর্থ মহাশক্তিময়/ক্ষমতাবান ২ঃ২০, ২ঃ১০৬, ২ঃ১০৯)

২) তোমরা কি জানো অন্ধকারের মহাশক্তিময় যুগ কি?

৩) অন্ধকারের মহাশক্তিময় যুগ (লাইলাতুল ক্বদরি) মনোনীত হয়েছে/আধিপত্য লাভ করেছে (খাইরুন, ৫৬ঃ২০, ৬৮ঃ৩৮, ২০ঃ১৩, ২৮ঃ৬৮, ৪৪ঃ৩২) অশুভ শক্তিদের ঐক্যবদ্ধতার মাধ্যমে (মিন আলফি, ২৪ঃ৪৩, ৩ঃ১০৩) একটি সুপরিচিত সময়ে (শাহরিন)

অর্থাৎ অশুভ শক্তিদের একীভুত বা ঐক্যবদ্ধ হবার কারণে একটি মহাশক্তিময় অন্ধকার যুগের উদ্ভব হয়েছিল।

৪-৫) অবতীর্ণ (তানাজ্জালুল) প্রাকৃতিক শক্তি (মালাইকা) এবং (ওয়া) প্রাকৃতিক উপাদান (রুহ, যেমন বাতাস, ১৭ঃ৬৯, ১৫ঃ২২, ১০ঃ২২, ৭ঃ৫৭) এই অন্ধকার মহাশক্তিময় যুগে (ফি হা) তোমার রবের অনুমতিক্রমে (বি ইজনি রাব্বিহিম) তার নির্দেশনা থেকে (মিন কুল্লি আমর, আমর-৫১ঃ৪, ৫৭ঃ১৪, ৪২ঃ৫২) শান্তি এনেছিল (সালামুন হিয়া) যতক্ষণ না পর্যন্ত পাপাচার আবৃত হয় (হাত্তা মাতলাই আল-ফাজর)।

মাতলাইল শব্দটা ৫০ঃ১০, ৩৭ঃ৬৫ আয়াতে আছে যেখানে খেজুরের আবরণকে “তা’লুন” বলা হচ্ছে। আল ফুজারি/ফাজর এর অর্থ হলো পাপাচার (wickedness) যা হলো মুত্তাকি এর বিপরীত শব্দ (৩৮ঃ২৮)

বিশ্লেষণ

১) ১৬ঃ২ দেখা যায় কিভাবে মালাইকা এবং রুহ একসাথে কাজ করে আল্লাহর আদেশ তার বান্দার হৃদয়ে পৌঁছে দেয়।

২) ২৬ঃ১৯২-১৯৪ দেখা যায় কুরআনটা মালাইকা ও রুহ এর মাধ্যমে (বিহি) অবতীর্ণ হয়েছে সরাসরি রাসুলের হৃদয়ে। স্পষ্ট আয়াত।

প্রচলিত তাফসিরকারকরা এই “রুহ” এর নাম দিছে জিব্রাইল, যা বাইবেল থেকে আসছে? কুরআনে জিব্রিলকে কোথাও রুহ বা মালাইকা বলা হয়নি। জিব্রিল অন্য টপিক।

৩) ৯৭ঃ৩ এ আলফি শব্দটার অর্থ সম্মিলিত হওয়া/একত্রিত হওয়া/একীভূত হওয়া। এই কনটেক্সে অশুভ শক্তিরা একত্রিত হয়ে একটি মহাশক্তিময় অন্ধকার যুগের সূচনা করেছিল, যা সমাজে সুপরিচিত তীব্র অস্থির সময় (শাহরু রামাদান) এর জন্ম দিয়েছিলো।

৪) খাইরুন শব্দটার সাধারণ অর্থ হলো better/উত্তমতর। কিন্তু এটির অর্থ আধিপত্য (superiority) লাভ বা মনোনীত (chosen) হতে পারে কন্টেক্সট অনুসারে।

৫) মালাইকা আর রুহ যে শান্তি এনেছিল তা হলো কুরআন। এই কুরআন অধ্যয়ন ও আত্মস্হ (কুল ওয়া আশরাবু) করার মাধ্যমে মানুষকে পাপাচারের অন্ধকার রেখা (মিন আল ফাজরি) থেকে আলোর রেখায় নিয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল (২ঃ১৮৭)। যদিও অধিকাংশই ঈমান আনেনি এবং রাসুলগণ বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল (২৩ঃ৫১-৫২) এবং রাসুল অভিযোগ করেছিলেন যে “আমার সম্প্রদায় এ কুরআনকে পরিত্যাগ করেছে (২৫ঃ৩০)।” এসব কারণে আরবজাতি যে মহাশক্তিময় অন্ধকার যুগে ছিল, গত ১৪০০ বছর ধরে সেখানেই ছিল এবং এখনো সেখানেই পড়ে আছে। এবং তাদের সেই অন্ধত্ব ছড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ পাকিস্তান আফগানিস্তান সহ সকল তথাকথিত মুসলিম দেশ গুলোতে।

সারমর্মঃ

১) অশুভ শক্তিদের একীভূত হবার কারণে একটি মহাশক্তিময় অন্ধকার যুগের সুচনা হয় যা সমাজে তীব্র অস্থিরতা (শাহরু রামাদান) এনে দিয়েছিল। সে সময়ে কুরআন নাজিল হয় সরাসরি রাসুলের হৃদয়ে মালাইকা ও রুহ এর মাধ্যমে। (২৬ঃ১৯২-১৯৪)।

উদাহরণ স্বরূপ সমাজে যদি সব দুর্নীতিবাজ একত্রিত হয়, তাহলে এই অশুভ শক্তির বিপক্ষে দাঁড়ানোর মত সৎ মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না।

২) সে যুগে নিসা/নির্ভরশীলদের সাথে অসদাচরণ (রাফাছু) করা হতো (২ঃ১৮৭)। সে যুগেও দখল বানিজ্য করা হতো এবং বিচারককে ঘুষ দিয়ে রায় নিজের পক্ষে আনা হতো। (২ঃ১৮৮)

৩) তাই যারাই সে ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে গিয়েছে (ফামান শাহিদা মিনকুন) তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সেই মহা অশুভ শক্তিকে প্রতিহত/বিরত করার সংকল্পবদ্ধ হতে (সিয়াম পালন) (২ঃ১৮৫) এবং মানুষের প্রয়োজনে আওয়াজ তুলতে/প্রতিবাদ করতে (২ঃ১৮৯)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *