আমরা আগের পর্বগুলোতে জেনেছি ;
সালাতের অর্থ সংযোগ বা যোগাযোগ – এবং আরও নির্দিষ্টভাবে, আল্লাহর সাথে মানুষের সংযোগ বা যোগাযোগ। আল্লাহ মানুষের সাথে যোগাযোগ করেন রাসুলের মাধ্যমে কিতাব/গ্রন্থ পাঠিয়ে এবং ওহী করে , আর মানুষ আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করে সালাতের মাধ্যমে।]

সালাত তথা যোগাযোগ ব্যাপক অর্থে সব ভাষাতেই ব্যবহার হয়। এটি ব্যবহারিক ও আত্মিক (মনের যোগ), দুই অর্থেই ব্যবহৃত হয়। বাক্যের প্রসঙ্গ /context অনুযায়ী যেমন যোগাযোগের মানে / মাধ্যম পরিবর্তন হয় , তেমনি কুরআনের আয়াতের প্রসঙ্গ অনুযায়ী সালাতের মানে ও পরিবর্তন হয়।

এখন, বহু-অর্থবোধক শব্দ সালাত, যা মূলত সংযোগ বা যোগাযোগকে বোঝায়, সাথে অন্যান্য সম্পর্কিত অর্থ যেমন যোগাযোগ, (কারো)দিকে ফিরে আসা, কাছাকাছি হওয়া, বন্ধন, ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করা, সমর্থন করা, সংযুক্ত থাকা ইত্যাদি হয় প্রসঙ্গের উপর নির্ভর করে। সালাত মূলটি কুরআনে ৯৯ বার চারটি আকারে এসেছে: বিশেষ্য হিসেবে ৮৩ বার সালাত (সংযোগ/যোগাযোগ), ১২ বার ক্রিয়াপদ হিসাবে ‘সাল্লা’ (সমর্থন বা ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করুন), ৩ বার সক্রিয় অংশীদার মুসাল্লিন হিসাবে (যারা সংযোগ/যোগাযোগ/অনুসরণ করে , এবং একবার বিশেষ্য হিসাবে মুসাল্লান (যোগাযোগের স্থান)।

প্রথমে সেই সমস্ত আয়াত নিয়ে ভাবুন , যেখানে সালাত শব্দটি প্রচলিত ভাবে কিন্তু ভুলভাবে ধর্মীয় প্রার্থনা বা নামাজ হিসাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। তাহলে দেখবেন যে , এই আয়াত গুলি আরও ভালো অর্থপূর্ণ হয় যদি নামাজের পরিবর্তে সালাত শব্দটিকে এর আসল কুরআনিক অর্থ, যেমন সংযোগ বা যোগাযোগ – এবং আরও নির্দিষ্টভাবে, আল্লাহ ও আল্লাহর বার্তার সাথে সংযোগ বা যোগাযোগের মাধ্যমে বুঝি। আল্লাহর নিকট চাইলে সব কিছু সকলের বুঝে আসবে। যদি কোন আয়াতে সালাতের মানে যোগাযোগ করলে বোধগম্য না হয় , তাহলে আবার পড়ুন,চেষ্টা করুন।

মধ্যবর্তী সালাত কোনটি?

২:২৩৮ حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلَاةِ الْوُسْطَىٰ وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ
সমস্ত সালাতের (সালাওয়াত الصَّلَوَاتِ) প্রতি মনোযোগী হও ( حْفَظُوا ) , বিশেষ করে উত্তম (আলউসতা الْوُسْطَىٰ) সালাতের ব্যাপারে। আর আল্লাহর জন্য একান্ত আদবের সাথে দাঁড়াও(وَقُومُوا)।

সালাতের সঠিক মানে সকলের কাছে পরিস্কার বোধগম্য হওয়ার জন্য এই আয়াতটি একটি গুরুত্বপূর্ন আয়াত। এই আয়াতের ব্রাকেটবন্দী ৪ টি আরবি শব্দ নিয়ে আলোচনা করব যেগুলোর মানে পার্শি ইমামরা পরিবর্তন করেছে। কুরআনের অন্যান্য আয়াতে ও এই একই শব্দগুলি ব্যবহৃত হয়েছে এবং ঐ সকল আয়াতের মাধ্যমে এই আরবি শব্দগুলির সঠিক মানে জানার চেষ্টা করব।

১) সালাওয়াত الصَّلَوَاتِ- পার্শি ইমামরা এই শব্দের মানে করেছে নামাজগুলো। সালাত একবচন -সালাওয়াত বহুবচন।
সালাওয়াতের মানে যে নামাজগুলো হতে পারে না বা সম্ভব নয় তা আমরা জানতে পারি নিম্নের আয়াত থেকে:

‎{أُولَـٰئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِّن رَّبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ ۖ وَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ
তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর সালাওয়াত ( صَلَوَاتٌ ) ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েত প্রাপ্ত।২:১৫৭}

এই আয়াতের সালাওয়াতের মানে যদি নামাজগুলি করেন তাহলে কি কোন মানে হয়? আল্লাহ সেই সমস্ত লোকের প্রতি নামাজগুলি পড়েন? কোন পাগলেও এটা বিশ্বাস করবে? তাহলে সালাওয়াতের মানেই বা কী , যেটা আবার রহমত ও এবং যা পেলে মানুষ হেদায়েত প্রাপ্ত হয়, যেমনটি এই আয়াতে বলা হয়েছে? এটা জানতে ১৫১ আয়াত থেকে পড়ে আসেন তাহলে জানবেন এগুলো হলো আল্লাহর বাণী ও বিভিন্ন উপদেশ। আল্লাহ মানুষের সাথে খোশ গল্প করার জন্য যোগাযোগ করেন না , তিনি যোগাযোগ করেন পথ দেখানোর জন্য , হেদায়েতের জন্য। বাণী , কথা এগুলো যোগাযোগের একটি রূপ। আল্লাহ এই যে বাণী ও উপদেশের মাধ্যমে মানুষের সাথে যোগাযোগ করলেন , এটাই সালাওয়াত। এই সালাওয়াত (বাণী) ,যারা মেনে চলল , তারাই হেদায়েতপ্রাপ্ত।

২) আলউসতা الْوُسْطَىٰ এর মানে ইমামরা করেছে মধ্যবর্তী। কোরআনে আর যত জায়গায় আলউসতা শব্দটি আছে সে সকল জায়গায় মধ্যবর্তী অনুবাদ করলে আয়াতের কোন মানে হয় না। উসতা মানে ভাল, উত্তম ইত্যাদি। চলুন দেখা যাক:

‎{قَالَ أَوْسَطُهُمْ أَلَمْ أَقُل لَّكُمْ لَوْلَا تُسَبِّحُونَ
তাদের উত্তম ব্যক্তি (أَوْسَطُهُمْ ) বললঃ আমি কি তোমাদেরকে বলিনি? এখনও তোমরা আল্লাহ তা’আলার পবিত্রতা বর্ণনা করছো না কেন? ৬৮:২৮}

উপরের আয়াতে দুই জন মানুষের মধ্য থেকে এক জনের কথা বলা হয়েছে। অনেক মানুষের মধ্য থেকে তো আর মধ্যম বা মধ্যবর্তী বাছাই করা যায় না। চলুন আরো আয়াত দেখি:

Al-Ma’idah ৫:৮৯

لَا يُؤَاخِذُكُمُ اللّٰهُ بِاللَّغْوِ فِيْۤ اَيْمَانِكُمْ وَلٰكِنْ يُّؤَاخِذُكُمْ بِمَا عَقَّدْتُّمُ الْاَيْمَانَ ۚ فَكَفَّارَتُهٗۤ اِطْعَامُ عَشَرَةِ مَسٰكِيْنَ مِنْ اَوْسَطِ مَا تُطْعِمُوْنَ اَهْلِيْكُمْ اَوْ كِسْوَتُهُمْ اَوْ تَحْرِيْرُ رَقَبَةٍ ؕ فَمَنْ لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلٰثَةِ اَيَّامٍ ؕ ذٰلِكَ كَفَّارَةُ اَيْمَانِكُمْ اِذَا حَلَفْتُمْ ؕ وَاحْفَظُوْۤا اَيْمَانَكُمْ ؕ كَذٰلِكَ يُبَيِّنُ اللّٰهُ لَكُمْ اٰيٰتِهٖ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ

আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করেন না তোমাদের অর্থহীন কসমের ব্যাপারে, কিন্তু যে কসম তোমরা দৃঢ়ভাবে কর সে কসমের জন্য তোমাদেরকে পাকড়াও করেন। সুতরাং এর কাফফারা হল দশ জন মিসকীনকে খাবার দান করা, মধ্যম ধরনের খাবার, যা তোমরা স্বীয় পরিবারকে খাইয়ে থাক, অথবা তাদের বস্ত্র দান, কিংবা একজন দাস-দাসী মুক্ত করা। অতঃপর যে সামর্থ্য রাখে না তবে তিন দিন সিয়াম পালন করা। এটা তোমাদের কসমের কাফ্ফারা, যদি তোমরা কসম কর, আর তোমরা তোমাদের কসম হেফাযত কর। এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াত সমূহ বর্ণনা করেন যাতে তোমরা শোকর আদায় কর।

{ … অতএব, এর কাফফরা এই যে, দশজন দরিদ্রকে খাদ্য প্রদান করবে; ভাল (أَوْسَطِ) খাদ্য যা তোমরা স্বীয় পরিবারকে দিয়ে থাক।…৫:৮৯}

উপরের আয়াতে দেখুন – আউসাত মানে ভালো কারন আমরা যথাসাধ্য নিজের পরিবার পরিজনকে ভালো/ উত্তম খাদ্যই দিয়ে থাকি , মধ্যম বা মধ্যবর্তী খাদ্য নয়। দান খয়রাত করা নিয়ে একটি সাধারন নির্দেশ আছে কুরআনে।

ভাবুন-
Al-Baqarah ২:২৬৭

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْۤا اَنْفِقُوْا مِنْ طَيِّبٰتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّاۤ اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِّنَ الْاَرْضِ ۪ وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيْثَ مِنْهُ تُنْفِقُوْنَ وَلَسْتُمْ بِاٰخِذِيْهِ اِلَّاۤ اَنْ تُغْمِضُوْا فِيْهِ ؕ وَاعْلَمُوْۤا اَنَّ اللّٰهَ غَنِيٌّ حَمِيْدٌ

{হে ঈমানদারগণ! তোমরা স্বীয় উপার্জন থেকে এবং যা আমি তোমাদের জন্যে ভূমি থেকে উৎপন্ন করেছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট বস্তু ব্যয় কর এবং তা থেকে নিকৃষ্ট জিনিস ব্যয় করতে মনস্থ করো না। কেননা, তা তোমরা কখনও গ্রহণ করবে না; তবে যদি তোমরা চোখ বন্ধ করে নিয়ে নাও। জেনে রেখো, আল্লাহ অভাব মুক্ত, প্রশংসিত।২:২৬৭}

৩)কুমু وَقُومُوا মানে দাঁড়ানো বা কায়েম থাকা। আল্লাহর আদেশ নিষেধ বা হেদায়েতের উপরে কায়েম থাকা যায় আক্ষরিক অর্থে দাঁড়ানো যায় না। এখানে দাঁড়ানো রুপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

৪) حْفَظُوا মানে রক্ষা করা /হেফাজত করা।

৫:৮৯ আয়াতে বলা হয়েছে – وَاحْفَظُوا أَيْمَانَكُمْ তোমাদের শপথ সমূহ রক্ষা কর। শপথ রক্ষা করার মানে শপথ না ভাঙ্গা। তদ্রুপ আল্লাহর সালাওয়াত রক্ষা করার মানে আল্লাহর বাণী ভুলে না যাওয়া বা স্মরন করা বা মনযোগ দেয়া , চোর ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা করা নয়।

২:২৩৮ আয়াতের আগে পিছের আয়াতগুলো পড়ুন , তাহলে দেখবেন- ২২১ আয়াত থেকে ২৩৭ আয়াতে নারী , বিয়ে ও তালাক সংক্রান্ত বিভিন্ন আদেশ , নিষেধ ও উপদেশ দেয়া আছে। ২৩৮ আয়াতে সালাওয়াতের কথা বলে আবার ও ২৪০-২৪২ আয়াতে তালাকের কথা বলে শেষ হয়েছে এভাবে-“এভাবেই আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্য স্বীয় নির্দেশ বর্ণনা করেন যাতে তোমরা তা বুঝতে পার।”

সালাওয়াতুল উসতা দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে?

আমরা বুঝতে পারি ২:২৩৮ সালাওয়াত শব্দটি দিয়ে কোন পার্শি নামাজ নয় বরং নারী , বিয়ে ,তালাক সংক্রান্ত নির্দেশ দিয়ে মানুষের সাথে যোগাযোগ করেছেন এবং নির্দেশগুলো তে মনযোগী হতে বলেছেন বিশেষ করে উত্তমগুলো। নিজের পরিবারের জন্য উত্তম খাদ্য যেভাবে নিজেরাই ঠিক করি , তেমনি যার জন্য যেমন প্রযোজ্য সে তেমনি ভাবে নারী , বিয়ে , তালাক সংক্রান্ত নির্দেশের কোনটা উত্তম তা ঠিক করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *